আদমজী জুট মিল

আদমজী জুট মিলের প্রধান ফটক (বতর্মানে আদমজী ইপিজেড)

আদমজী জুট মিল   ১৯৫০ সালে ঢাকার অদূরে  নারায়ণগঞ্জ-এ স্থাপিত হয়। কয়েক বছরের মধ্যে মিলটি বিশ্বের সর্ব বৃহৎ পাটকলে পরিণত হয়। তবে মিলটি ১৯৭২ সালের পর থেকে নানা কারণে অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হয় এবং ক্রমাগত আর্থিক ক্ষতি ও রাষ্টীয় ভর্তুকির কারণে ২০০২ মিলটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বাংলায় ১০৮টি পাটকল ছিল কিন্তু সবগুলি পাটকল ছিল ভারতে। পাকিস্তান সরকার দেশে মুসলিম শিল্পোদ্যোক্তাদের পাটকল স্থাপনে উৎসাহিত করে। এর প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালে কলকাতার আদমজী ব্রাদার্স উদ্যোক্তা হিসেবে একটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। প্রস্তাব অনুযায়ী আদমজী ব্রাদার্স শেয়ার মূলধনের শতকরা ৫০ ভাগ পরিশোধ করে এবং অবশিষ্ট ৫০ ভাগ শেয়ার মূলধন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইডিসি) প্রদান করে। নারায়ণগঞ্জের প্রায় ৬ কিমি উত্তরে অবস্থিত নদী, সড়ক এবং রেল-যোগাযোগের সুবিধাপূর্ণ স্থান সিদ্ধিরগঞ্জে মিলটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এ মিল নির্মাণের জন্য ২২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পিআইডিসি সরকারের মঞ্জুরীকৃত বৈদেশিক মুদ্রায় মিলটির জন্য কলকব্জা ও সরঞ্জাম আমদানির ব্যবস্থা করে এবং ১৯৫৫ সালের জুন মাসে মিলটির উৎপাদন কাজ শুরু করার জন্য ৩,০০০টি লুম ও ৩১,২০০টি টাকু বসানো হয়। মিলটির ১১৭ টন পাকানো দড়ি, ৯৫৩ টন চট এবং ৪,০০৬ মে টন বস্তা উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল। মিলটি মুক্তিযুদ্ধের পর  পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় এবং ১৯৭২ সালে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

এই মিলে উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, বিপণন, কর্মচারী পরিদপ্তর, প্রকৌশল, অর্থ এবং গণযোগাযোগ বিভাগসহ মোট ১৮টি বিভাগ থাকে। প্রাথমিকভাবে এ মিলে হিসাবনিকাশ সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণে সনাতনী পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। ১৯৬৭ সালে এটিকে সমন্বিত হিসাব ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। নতুন পদ্ধতিটি প্রস্ত্ততকৃত তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে ব্যয়-নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়। সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সমান অংশীদার থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আদমজী পরিবারই মিলের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৭২ সালে মিলটি জাতীয়করণের পর বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে আরম্ভ করে, যেমন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মচারী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কর্মশৃঙ্খলার অভাব, অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা, বৈরী ট্রেড ইউনিজম ইত্যাদি। নতুন ব্যবস্থাপনা পণ্যের মানের নিশ্চয়তা প্রদানে এবং বৈদেশিক ক্রেতার চাহিদানুযায়ী উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবণতির ফলে মিলটি নিয়মিত লোকসান গুণতে থাকে।

জুট মিলের ভিতরের দূশ্য

১৯৯৯-২০০০ সালে মিলে চটের জন্য ১,৯৩৯টি, বস্তার জন্য ১,১০৩টি এবং কার্পেট ব্যাকিং ক্লথের জন্য ২৩৪টি লুম ছিল। এর মধ্যে চটের জন্য ১,০৮৫টি, বস্তার জন্য ৭২৬টি এবং কার্পেট ব্যাকিং ক্লথের জন্য ১৭২টি লুম ব্যবহারোপযোগী ছিল। বুননে প্রাক্কলিত উৎপাদন মাত্রা ছিল চট ১৯,০০২ মে টন, ব্যাগ ৩৪,৬০৯ মে টন ও কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ ৬,০০৪ মে টন এবং প্রকৃত উৎপাদন ছিল চট ১০,২৮৪ মে টন, ব্যাগ ২১,২৩৬ মে টন ও কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ ৩,২৫৪ মে টন। মিলে নিয়োজিত ছিল ৫১৫ জন কর্মকর্তা, ১,৫৬১ জন অন্যান্য অফিস কর্মী এবং ১৬,৪৪৩ জন শ্রমিক। ১৯৯৯-২০০০ সালে টনপ্রতি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রমদিবস ধরা হয় চটের জন্য ২১৮, ব্যাগ ৯৪ এবং কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ ১৩১, যা ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে ছিল যথাক্রমে ১৮৯, ৮৮ এবং ১১২। আদমজী জুট মিলে চট, ব্যাগ এবং কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হয় এবং এ সমস্ত সামগ্রীর টনপ্রতি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রমদিবসও পাঁচ বছরে বেড়ে যায়। মিলটিতে অবশ্য কাঁচামাল ব্যবহারে কিছু উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রতিটন চট উৎপাদনে ১,৬৭২ কেজি, প্রতিটন ব্যাগ উৎপাদনে ১,৪৯৪ কেজি এবং প্রতিটন কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ উৎপাদনে ১,৮১৩ কেজি কাঁচা পাট প্রয়োজন হয় এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে এ পরিমাণগুলি ছিল যথাক্রমে ১,২৮১ কেজি, ১,১০৪ কেজি এবং ১,৪৪৭ কেজি। কাঁচামাল ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার ফলে যে সাশ্রয় হয় মজুরি খাতে বাড়তি ব্যয়ের কারণে মিলটি তার প্রাপ্য সুবিধাটুকু হারায়। ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে চট, বস্তা এবং কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ উৎপাদনে টনপ্রতি মজুরি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ২৩,০৯২ টাকা, ১৫,৭৮০ টাকা এবং ২২,২৪৮ টাকা, আর ১৯৯৯-২০০০ সালে তা দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৭,২৪৮ টাকা, ১৮,৫৯৬ টাকা এবং ২৫,৮০০ টাকা।

অব্যাহত লোকসানের কারণে সরকার ২০০২ সালের ৩০ জুন আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়। তবে সম্প্রতি সরকার চিন্তা ভাবনা করছে মিলটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য।

[এম. হবিবুল্লাহ]