অবলিখন

অবলিখন কোনো ব্যবসায় সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিহিত ঝুঁকি অন্যের ওপর স্থানান্তরের ধারণা ও প্রক্রিয়া থেকে অবলিখন কাজের উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়। ব্যবসায় সম্পাদন প্রক্রিয়ায় যখন তৃতীয় কোনো পক্ষ তা সম্পাদনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে প্রথম পক্ষের নিকট থেকে প্রিমিয়াম গ্রহণ করে তখন আভিধানিক অর্থে নির্দিষ্ট প্রাপ্তির বিপরীতে ঝুঁকি গ্রহণের কাজকে অবলিখন বলা হয়। সামুদ্রিক বীমা পদ্ধতির মাধ্যমে আনুমানিক ১৬৮৯ সালে লন্ডন শহরে ঝুঁকি হস্তান্তর বা অবলিখন প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিসমূহের নতুন শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে অবলিখনের এ পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু হয় এবং ১৮৪৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম কোম্পানি আইন পাশ ও প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে অবলিখন বলতে কোম্পানির শেয়ার ইস্যুর ঝুঁকি স্থানান্তর ও গ্রহণের কাজকেই বোঝানো হতে থাকে।

একটি কোম্পানির ইস্যুকৃত সমুদয় শেয়ারই অনায়াসে বিক্রয় হবে এমনটা সাধারণত ঘটে না। শেয়ার অবিক্রিত থাকার ঝুঁকি গ্রহণ করে অবলেখক। কোনো কোম্পানির ইস্যুকৃত সকল শেয়ার ক্রয়ের জন্য আবেদন না এলে এবং সে কারণে শেয়ার অবিক্রিত থাকলে ঐসব অবিক্রিত শেয়ার কিনে নেওয়ার অগ্রিম নিশ্চয়তা প্রদানের কাজই হচ্ছে অবলিখন, যার বিনিময়ে অবলেখক শেয়ার ইস্যুকারী কোম্পানির নিকট থেকে কমিশন পেয়ে থাকে। অবলিখন চুক্তির অধীনে গৃহীত শেয়ারগুলি পুনঃবিক্রয়ের জন্য অবলেখক যথাযথ সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় থাকে। কখনও কখনও কিছু অবলেখক, যেমন ব্যাংক, বীমা কোম্পানি বা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের অবলিখনকৃত শেয়ারের পুরোটা বা অংশবিশেষ বিক্রয় না করে তাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওভুক্ত করার মাধ্যমে স্থায়ী পরিসম্পদের পরিমাণ বাড়ায়। অবলেখকগণ শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও ইস্যুকারী কোম্পানি অথবা শেয়ারসমূহের ইস্যু ম্যানেজারদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা প্রদান করে। বিভিন্ন পদ্ধতি বা ব্যবস্থার অধীনে ইস্যুকারী কোম্পানির নিকট থেকে অবলেখক শেয়ার ক্রয় করে। এ সকল ব্যবস্থা হচ্ছে নিশ্চিত অঙ্গীকার (firm commitment), সর্বোত্তম প্রচেষ্টা (best effort), কিংবা সব অথবা মোটেই-না (all or none) পদ্ধতি। শেয়ার ও ডিবেঞ্চার অবলিখনকারীরা অঙ্গীকার প্রদানের মাধ্যমে ইস্যুকারী কোম্পানিকে নিশ্চিতভাবে জানায় যে, তারা অবলিখনকৃত সব শেয়ার/ডিবেঞ্চার বিক্রয় করবে এবং ওই শেয়ার ও ডিবেঞ্চারের কিছু অংশ অবিক্রিত থাকলে তারা নিজেরাই নির্ধারিত মূল্যে সেগুলি কিনে নেবে। সর্বোত্তম প্রচেষ্টা-পদ্ধতিতে অবলেখক নিজে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ক্রয় করে না এবং সব শেয়ার/ডিবেঞ্চার বিক্রয় করে দেওয়ার নিশ্চয়তাও প্রদান করে না। তবে এ নিশ্চয়তা প্রদান করে যে, অবলেখক সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারিত মূল্যে নিজে সকল শেয়ার বিক্রয়ের জন্য সর্ব উপায়ে চেষ্টা করবে। সর্বোচ্চ উদ্যম ও প্রচেষ্টার পরও কোনো শেয়ার/ডিবেঞ্চার অবিক্রিত থাকলে অবলেখক সেগুলি ইস্যুকারী কোম্পানিকে ফেরত দেবে। সাধারণত ইস্যুকারী কোম্পানি যদি সুপরিচিত ও স্বনামধন্য না হয়, তখন ইস্যুকারী ও অবলেখকের মধ্যে best effort চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো বা বণ্টন করা হয়। অবলেখক সর্বোচ্চ বাজারমূল্যে শেয়ার বিক্রয়ের জন্য সচেষ্ট থাকে। যদি ইস্যুকৃত শেয়ার বিক্রেতার দরে (offer price) সম্পূর্ণভাবে বিক্রয় না হয়, তখন ওই অবস্থাকে বলা হয় called off এবং এ অবস্থায় ইস্যুকারী কোম্পানি কিছু/কোন অর্থ পায় না। ইস্যুকৃত শেয়ারের সংখ্যা যদি অত্যধিক হয় তখন কিছুসংখ্যক অবলেখকের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শেয়ার ও ডিবেঞ্চারসমূহ বিতরণের প্রথা বিশ্বে প্রচলিত আছে।

১৯৪৯ সালে করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন ও রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানে কোম্পানিসমূহ ইকুইটি শেয়ার ও গিল্ট-এজড সিকিউরিটিজ বাজারের পত্তন হয়। বিনিময়যোগ্য মূলধনের স্বল্পতা এবং স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনীহার কারণে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের ইকুইটি শাখার কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ছিল। ১৯৫২-৫৩ সময়কালে স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন ও কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে দেশের মূলধন বাজার-এর গতিশীলতা আনয়ন ও উন্নয়নের জন্য পাকিস্তান সরকার দেশের কিছু আর্থিক ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার ও ডিবেঞ্চার অবলিখন করার জন্য অনুমোদন প্রদান করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব পাকিস্তান। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান একক বা কনসোর্টিয়াম-এর মাধ্যমে শেয়ার/ডিবেঞ্চার অবলিখন করে পাকিস্তানের মূলধন বাজারের বিনিয়োগের ভিত মজবুত করে।

১৯৫৪ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ইস্ট পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জের নাম পরিবর্তন করে ১৯৬২ সালে এর নাম দেওয়া হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি.। কিন্তু মাত্র ৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমেত  ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয়ের একটি ক্ষুদ্র কেন্দ্র হিসেবে থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১৯৭১-৭৫ সময়কালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি.-এর কর্মকান্ড স্থগিত ছিল। বাজার অর্থনীতির লক্ষ্যে সরকার বেসরকারীকরণ এর নীতিমালা গ্রহণের ফলে ১৯৭৬ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। দেশে শিল্পায়ন ত্বরান্বিতকরণ এবং একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সিকিউরিটিজ বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৬ সালে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশের মূলধন বাজার উন্নয়নের পথে এটি ছিল একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ। কোম্পানিসমূহের শেয়ার ও ডিবেঞ্চারের অবলিখন করা ছিল সে সময়ে আইসিবি-র মুখ্য কাজ। ১৯৭৬-৮০ সময়কালে আইসিবি সর্বমোট ৪০০ মিলিয়ন টাকা মূল্যের শেয়ার অবলিখন করে। মূলধন প্রবাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সরকার পরবর্তী সময়ে  বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি),বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা (বিএসআরএস), সরকারি খাতের জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানিসমূহ এবং জাতীয়করণকৃত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে শেয়ার ও ডিবেঞ্চার অবলিখন করার জন্য অনুমতি দেয়। এককভাবে অবলিখন করা ছাড়াও বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানি এবং বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম-এর মাধ্যমে বিএসবি ও বিএসআরএস, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড এবং  পূবালী ব্যাংক লিমিটেড শেয়ার ও ডিবেঞ্চার অবলিখনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যান্ড পোর্টফোলিও ম্যানেজার) রেগুলেশন ১৯৯৫-এর অধীনে ১৯৯৭ সালে ১৭টি  অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মার্চেন্ট ব্যাংকিং করার অনুমোদন দেওয়ার পূর্বপর্যন্ত আইসিবি, বিএসবি, বিএসআরএস এবং জাতীয়করণকৃত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিসমূহ সিকিউরিটিজ বাজারে মুখ্য অবলেখকের ভূমিকা পালন করে। উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহসহ সম্প্রতি অনুমোদনপ্রাপ্ত ২৭টি প্রাইভেট মার্চেন্ট ব্যাংকার বর্তমানে বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ বাজারে শেয়ার ও ডিবেঞ্চার অবলিখনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বাজারে নতুন শেয়ার ইস্যুর (আইপিও) পরিমাণ বৃদ্ধির উপর অবলিখন কার্যক্রমের পরিমাণ নির্ভরশীল। পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ জনগণের ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নতুন ইস্যুর পরিমাণ বেশ কম। দেশের শিল্পায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি না থাকায় পুঁজিবাজার যথেষ্ট পরিমাণ বিকশিত হয়নি। তাছাড়া ব্যাংক নির্ভর অর্থায়নের প্রবণতা এবং নিশ্চয়তা অনেক সময় উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলে। এমতাবস্থায় পুঁজিবাজারে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাথমিক ইস্যু (আইপিও) আসেনা এবং অবলিখনের সুযোগ তৈরি হয় না। দেখা যায় যে ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৪ টি আইপিও ইস্যু হয়েছে যেখানে অবলিখনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। এমতাবস্থায় অবলিখন কার্যক্রমে যথেষ্ট প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবলিখন কার্যক্রম কার্যত ঝুঁকিহীন। কেননা নতুন ইস্যু এবং শেয়ারসংখ্যা কম হওয়ায় সর্বদাই প্রাথমিক ইস্যুর শেয়ার ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত চাপ পরিলক্ষিত হয়। ২০০৫ সাল থেকে প্রাথমিক ইস্যুর জন্য প্রতিবছর প্রায় ৬ থেকে ৭ গুণ অধিক পরিমাণে চাহিদাপত্র জমা পড়ে। এতে অবলিখনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বাধ্যতামূলকভাবে অবিক্রিত শেয়ার দায়ভার বহন করতে হয়নি। অধিকন্তু অবলিখন কার্যক্রমে তারা সহজে আয়ের একটি উৎস হিসেবেই ধরে নিয়েছে।

[আবুল কালাম আজাদ এবং আব্দুস সামাদ সরকার]