সিরামিক শিল্প

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:১০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

সিরামিক শিল্প  মাটি থেকে প্রস্ত্ততকৃত  প্রয়োজনীয় এবং শোভাবর্ধক পণ্যসামগ্রী। সিরামিক শিল্প প্রধানত মৃৎপাত্র উন্নয়ন এবং ব্যাপক অর্থে উচ্চ তাপমাত্রায় অধাতব পদার্থকে কঠিন বস্ত্ততে পরিণত করে যেকোন পণ্য তৈরির সাথে জড়িত। শিল্পে ব্যবহূত ধাতব বা অর্গানিক শক্ত মালামাল সিরামিকের অন্তর্ভুক্ত। সিরামিক পণ্যের মধ্যে আছে গ্লাস, পোড়ামাটির বাসনপত্র, চীনামাটির বাসন, চীনামাটির এনামেলস, ইটের টাইলস, টেরাকোটা, রিফ্রাকটরিজ, সিমেন্ট, চুন এবং জিপসাম।

মৃৎকর্ম সম্ভবত মানব সভ্যতার সবচেয়ে পুরাতন শিল্প। প্রথমদিকে মাটি দিয়ে শিল্পকর্ম শুরু হয়ে পরবর্তীকালে তা বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে অন্যান্য মাধ্যম, যেমন কাঠ, পাথর, ঝিনুক, ধাতব পদার্থ ইত্যাদির শিল্পকর্মে রূপ লাভ করে। সিরামিকের যুগ শুরু হওয়ার পূর্বে বাংলাও এ সমস্ত স্তর অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে আধুনিক সিরামিক শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, বগুড়ায় তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি. প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর উৎপাদন অত্যন্ত সীমিত ছিল এবং উৎপাদিত পণ্যের মানও তেমন একটা ভাল ছিল না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি. প্রতিষ্ঠিত হয় প্রধানত স্থানীয় বাজারে পণ্য সরবরাহের জন্য এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই কারখানার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি.। কারখানাটি ১৯৬৬ সালে উৎপাদন শুরু করেছিল।

২০১১ সালে বাংলাদেশে সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১-এ, যার মধ্যে ছয়টি বড় ধরনের। মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, শাইনপুকুর সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেঙ্গল ফাইন সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ফার সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ উন্নতমানের সিরামিক এবং চীনামাটির বাসন তৈরি করে। সিরামিক পণ্যের বাৎসরিক উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৫,০০০ টন এবং ৪৫টি দেশে রপ্তানির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৫,০০০ টন। অবশিষ্ট সিরামিক পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রয় হয়। ঢাকায় তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর একটি শোরুম এবং রপ্তানি বিভাগ রয়েছে। ১৯৫৮ সাল হতে এটি চীনামাটির টেবিল সরঞ্জাম উৎপাদন করে যা প্লান্টটির উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। এই কোম্পানি প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে আসছে। ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিমি দক্ষিণে টঙ্গী শিল্প এলাকায় অবস্থিত পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রতিদিনের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২৮,০০০ পিস টেবিল সরঞ্জাম। এই কোম্পানি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে কিছুটা সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি এটি ‘সুপার চায়না’ নামে একটি নতুন ব্রান্ড চালু করে যা বিদেশি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বেঙ্গল ফাইন সিরামিক লিমিটেড হালকা চীনামাটির বাসন তৈরি করে। কোম্পানি এগুলির নাম দিয়েছে স্টোনওয়্যার। এটি একটি অফ-হোয়াইট পণ্য, যা ময়মনসিংহের স্থানীয় গুণগত মানের মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। কারখানাটি উৎপাদন শুরু করেছিল ১৯৮৬ সনে। কোম্পানির প্রতিদিনের উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২৪,০০০ পিস (৬ টন) স্টোনওয়্যার। শুরু থেকেই কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছিল আন্তর্জাতিক বাজারকেন্দ্রিক এবং এটি এ প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছে। সম্প্রতি এটি একটি সহযোগী কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে যার নাম স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি.। এর অবস্থান ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিমি দক্ষিণে গাজীপুরে।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে সফল সিরামিক কোম্পানি হচ্ছে মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি.। এটি উৎপাদন শুরু করে ১৯৮৫ সনে এবং খুবই উন্নতমানের চীনামাটির টেবিল-সরঞ্জাম উৎপাদন করে। এই কোম্পানি রপ্তানি বাজারে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে। লন্ডনে এর একটি বিক্রয় অফিস রয়েছে এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে হাউজওয়্যার শো নামে এর একটি স্থায়ী স্টল রয়েছে। বিশ্বখ্যাত বোন চায়না এবং চীনামাটির টেবিল সরঞ্জাম প্রস্ত্ততের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৭ সনে শাইনপুকুর সিরামিক লি. প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই কোম্পানির অবস্থান গাজীপুরের বেক্সিমকো শিল্পনগরীতে। কোম্পানিটি চীনামাটির বাসন এবং চায়না উৎপাদন শুরু করেছিল যথাক্রমে এপ্রিল ১৯৯৯ এবং নভেম্বর ১৯৯৯-তে। ১৯৯৯ সনে বাণিজ্যিক উৎপাদনের শুরুতেই এটিকে দ্রুত উৎপাদনক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোম্পানিটি অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রায় ৬০% দখল করেছে এবং এর সিরামিক টেবিল সরঞ্জাম বিশ্ববাজারেও সমাদৃত।

বাংলাদেশে উৎপাদিত ও রপ্তানিকৃত সিরামিক পণ্যের প্রায় ৯৫% কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। যে সমস্ত দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি হয় সেগুলি হচ্ছে জাপান, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত। সিরামিক পণ্যের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে সাদা মাটি ও বালি। ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশ সাদামাটির বৃহৎ মজুত আবিষ্কৃত হয় ময়মনসিংহের বিজয়পুর এলাকায়। উক্ত এলাকায় সাদামাটির রিজার্ভ-এর পরিমাণ নিরূপিত হয় ২.৭ মিলিয়ন টন। সিলেটের জাফলং এলাকাতেও সাদামাটির সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু উক্ত এলাকাসমূহে মাটি বা বালি পরিশোধনের কোন প্লান্ট নেই।

বাংলাদেশের প্রায় সবকয়টি সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সঠিক মান বজায় রাখা এবং সুনাম ধরে রাখার জন্য উন্নতমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে। এসবের মেশিনারি ও যন্ত্রপাতি আধুনিক এবং উন্নত মানের। প্রতিটি সিরামিক ইউনিটের নিজস্ব ল্যাবরেটরি সুবিধা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে যে সমস্ত পণ্য বাজারজাত হচ্ছে সেগুলি হলো ডিনার সেট, টি সেট, কফি সেট, স্যুপ সেট, ফলের সেট, বাসন, পেয়ালা, ফুলদানি, মগ এবং বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির জাতীয় পণ্য। অধিকাংশ সিরামিক পণ্যই ওভেনপ্রুফ ও ডিশওয়াশার প্রুফ এবং এসবের কোন রাসায়নিক ক্ষতিকর প্রভাব নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ ৪৫টিরও বেশি দেশে সিরামিক পণ্য রপ্তানি করছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেন।  [জাকির হোসেন ভূঁইয়া]