রাগ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫২, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

রাগ  স্বর ও বর্ণসংযুক্ত সঙ্গীতের এক প্রকার ধ্বনিসমাবেশ, যা শ্রোতার মনকে আন্দোলিত করে। রাগের এই ধ্বনিসমাবেশ আরোহী ও অবরোহীর একটি বিশেষ নিয়মে ঘটে, যাকে বলা হয় রাগলক্ষণ। ঠাট থেকে রাগের উৎপত্তি। রাগ তিনভাগে বিভক্ত: সম্পূর্ণ, ষাড়ব ও ঔড়ব। সাত স্বরযুক্ত রাগ সম্পূর্ণ, ছয় স্বরযুক্ত রাগ ষাড়ব এবং পাঁচ স্বরযুক্ত রাগ ঔড়ব নামে পরিচিত। রাগের এই তিনটি মুখ্য জাতি থেকে আরোহী-অবরোহীতে ব্যবহূত স্বরসংখ্যা দ্বারা নয়টি জাতি পাওয়া যায়, যথা: সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-ষাড়ব, সম্পূর্ণ-ঔড়ব; ষাড়ব-সম্পূণ,র্ ষাড়ব-ষাড়ব, ষাড়ব-ঔড়ব; ঔড়ব-সম্পূর্ণ, ঔড়ব-ষাড়ব ও ঔড়ব-ঔড়ব। রাগের লক্ষণসমূহ হলো: ১. রাগ রচনায় যেকোন ঠাট থেকে স্বর নিতে হবে; ২. এতে কমপক্ষে পাঁচটি স্বর থাকবে এবং পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ থেকে কমপক্ষে দুটি করে চলস্বর থাকতে হবে; ৩. রাগে আরোহী ও অবরোহী থাকবে এবং তা বিশিষ্ট নিয়ম মেনে চলবে; ৪. রাগে বাদী, সমবাদী, অনুবাদী, বিবাদী (রাগ বিশেষ), বর্জিত (রাগের নিয়ম মাফিক), জাতি, প্যকড়, সময়, অঙ্গ, আলাপ বা বিস্তার, তাল, বোলতান, বাট, সরগম প্রভৃতি থাকবে; ৫. রাগে রঞ্জকতা গুণ  থাকবে; ৬. রাগে একটি বিশেষ রসের অভিব্যক্তি থাকবে; ৭. কোনও রাগেই ষড়জ স্বরটি বর্জিত হবে না; ৮. কোনও রাগেই মধ্যম ও পঞ্চম স্বর একসঙ্গে বর্জিত হবে না; ৯. কোনও রাগে একই স্বরের শুদ্ধ ও বিকৃত রূপ পাশাপাশি বসবে না, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে; ১০. রাগ সাত প্রকারে গঠন করা যায়: প্রথম প্রকার তিনভাগে বিভক্ত, যথা: শূদ্ধ, ছায়ালগ বা সালঙ্ক ও সংকীর্ণ। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে গঠিত রাগ শুদ্ধ, যথা ভৈরব; দুটি রাগের সংমিশ্রণে গঠিত রাগ ছায়ালগ বা সালঙ্ক, যেমন শুদ্ধকল্যাণ (আরোহে ভূপালী, অবরোহে ইমন) এবং দুইয়ের অধিক রাগের সংমিশ্রণে গঠিত রাগ সংকীর্ণ, যেমন জয়জয়ন্তী। অবশিষ্ট ছয় প্রকার বিশেষ ছয়টি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত এবং সেগুলি হচ্ছে রাগের ঢং বদলে দেওয়া (পূরিয়া ও মারবা), রাগের বাদী-সমবাদী দেওয়া (ভূপালী ও দেশকার), রাগের কোমল বা কড়ি স্বরগুলি বদলে দেওয়া (কাফি ও পূরবী), রাগের স্বর কমানো বা বাড়ানো (শুদ্ধকল্যাণ ও ভূপালী), রাগের স্থান বদলে দেওয়া (দরবারি কানাড়া ও আড়ানা) এবং রাগের সময় পরিবর্তন করে দেওয়া (সুহা কানাড়া ও নায়কী কানাড়া)।

রাগসঙ্গীত একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যনির্ভর সঙ্গীতরীতি। ভারতীয় সঙ্গীত ধারার ধ্রুপদ, খেয়াল, তারানা, টপ্পা, ঠুংরি ইত্যাদি শৈলীর সঙ্গে রাগ শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রচলিত।

প্রতিটি রাগ পরিবেশনের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। দিবারাত্রি ২৪ ঘণ্টাকে ৮ প্রহরে ভাগ করে বিভিন্ন রাগের জন্য এই সময় নির্ধারণ করা হয়। দিন ও রাত্রির মিলনক্ষণকে বলা হয় সন্ধিপ্রকাশ কাল এবং এ সময়ে পরিবেশিত রাগ সন্ধিপ্রকাশ রাগ নামে পরিচিত। সন্ধিপ্রকাশ সময় ছাড়া রাগকে সাধারণভাবে প্রাতর্গেয়, মধ্যাহ্নগেয়, সান্ধ্যগেয় ও রাত্রিগেয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিটি প্রহরে কোন-না-কোন ঠাটের রাগ প্রাধান্য পায়। একটি ঠাট থেকে পরবর্তী ঠাটে প্রবেশের জন্য পরবর্তী ঠাটের ইঙ্গিতবহ যে রাগ পরিবেশন করা হয়, সেই রাগটিকে বলা হয় পরমেল-প্রবেশক রাগ। অনেক সময় বিভিন্ন রাগ পরপর এক সঙ্গে পরিবেশন করা হয়, যাকে বলা হয় রাগমালা। রাগমালা শ্রবণে শ্রোতার মনে চমৎকার মিশ্রানুভূতির সৃষ্টি হয়।

বাংলা গানে রাগ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় হাজার বছর আগেকার চর্যাপদে। বিশুদ্ধ রাগে এর গানগুলি রচিত। পরবর্তীকালে গীতগোবিন্দম ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এ  রাগের পূর্ণ ব্যবহার দেখা যায়। চর্যাপদের রাগগুলি হচ্ছে পটমঞ্জরী, ভৈরব, অরু, বরাড়ী, গবড়া, শবরী, গুর্জরী, মল­ারী, দেবক্রী, গউড়া, দেশাখ, গবুড়া, ভৈরব, মালসী-গবুড়া, কামোদ, কাহ্নু-গুর্জরী, ধনসী, বঙ্গাল এবং রামক্রী। সম্ভবত গউড়া এবং গবুড়া আধুনিক গৌড় রাগ এবং গবড়া রাগটি আধুনিক গারা নামে পরিচিত।

গীতগোবিন্দমের রাগগুলি হচ্ছে গুর্জরী, মালবগৌড়, কর্ণাট, দেশাখ, দেশবরাড়ী, গোন্ডকিরী, মালব, বসন্ত, ভৈরবী, রামকিরী, বরাড়ী ও বিভাস। গীতগোবিন্দমের গানগুলি এসব রাগে রচিত এবং কোন গানটি কোন রাগ-তালে গেয় তা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাগগুলি হচ্ছে আহের, বিভাস, ককু, বিভাস কহূ, কহূ, বেলাবলী, গজ্জরী, ভাটিয়ালী, কেদার, ভৈরবী, কোড়া, মল­ার, কোড়া দেশাগ, মালব, দেশবরাড়ী, মালবশ্রী, দেশাগ, মাহারাঠা, ধানুষী, রামগিরি, পটমঞ্জরী, ললিত, পাহাড়ীআ, শৌরী, বঙ্গাল, শ্রী, বঙ্গাল বরাড়ী, শ্রীরামগিরি, বরাড়ী, সিন্ধোড়া, বসন্ত এবং কহূ-গুর্জরী। এ রাগগুলি বর্তমানেও কমবেশি ব্যবহূত হয় এবং বেশ জনপ্রিয়ও। কোন কোন রাগ বর্তমানে পরিবর্তিত নামে ব্যবহূত হচ্ছে, যেমন কোড়া রাগটি কৌঁসিকানাড়া নামে এখন প্রচলিত।

বাংলা গানে অনেকেই দক্ষিণ ভারতীয় রাগের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। এঁরা বাংলা গানে বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা রাগপ্রধান গানকে জনপ্রিয় করেছেন নজরুল ইসলাম। তিনি বেশকিছু নতুন রাগ সৃষ্টি করে তাতে গানও রচনা করেছেন। তাঁর সৃষ্ট রাগের মধ্যে বেণুকা, দোলনচাঁপা, দেবযানী, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, মীনাক্ষী, যোগিনী, নির্ঝরিণী বেশ জনপ্রিয়।  [মোবারক হোসেন খান এবং কৃষ্ণপদ মন্ডল]

গ্রন্থপঞ্জি  করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতকোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫; শরচ্চন্দ্র শ্রীধর পরাংজপে, সঙ্গীতবোধ, মধ্যপ্রদেশ হিন্দী গ্রন্থ একাডেমী, ভারত।