যক্ষ্মা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৩:৫৭, ৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

যক্ষ্মা  Mycobacterium tuberculosis নামের জীবাণুঘটিত দীর্ঘস্থায়ী এক সংক্রামক ব্যাধি। এ রোগ TB নামেও পরিচিত। যক্ষ্মা একটি প্রাচীন রোগ। সম্ভবত পঞ্চম শতকের প্রথম দিক থেকেই এটি মারাত্মক রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যক্ষ্মা জীবাণুর বিভিন্ন জাত গৃহপালিত পশু ও বন্যপ্রাণীদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটায়। এ রোগ সচরাচর ফুসফুসের ক্ষতি করে, কিন্তু শ্বাসতন্ত্র, অস্থি ও অস্থিসন্ধি, ত্বক, লসিকাগ্রন্থি, অন্ত্র, কিডনি এবং স্নায়ুতন্ত্রও আক্রমণ করে। শ্বাসগ্রহণের সময় জীবাণু ফুসফুসে প্রবেশ করলেই সাধারণত সংক্রমণ ঘটে। দূষিত খাদ্যগ্রহণেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। যক্ষ্মাগ্রস্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত কফ বা থুথুর কণাগুলি অন্যের শরীরে ও বাতাসে জীবাণু ছড়ায়। এসব জীবাণু বাতাসে, শুষ্ক কফ ও থুথুতে এবং ধূলাবালিতে দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকে। রোগটি অন্যদের তুলনায় একই পরিবারের লোকদের মধ্যে অধিক পরিমাণে সংক্রমিত হয়ে থাকে, কেননা এক পরিবারের সদস্যরা একই বাড়িতে বসবাস করে, একই টেবিলে খাবার খায় ও পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। তবে যক্ষ্মা বংশানুক্রমিক নয়।

এই রোগের সর্বাধিক প্রচলিত ও পরিচিত ধরনটি হলো ফুসফুসীয় যক্ষ্মা। শুরুতে ফুসফুসীয় যক্ষ্মার উপসর্গগুলি প্রকাশিত নাও হতে পারে। সক্রিয় অথবা প্রাথমিক অবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে ফুসফুসীয় যক্ষ্মায় কাশি, দুর্বলতা, ওজনহ্রাস, কফ ও থুথুর সাথে সামান্য রক্তপাত, ফুসফুসের স্থানসহ বুকব্যথা এবং জ্বর (যা দিনের বেলায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়) ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পায়। অধিক সংখ্যায় জীবাণু শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিস্তারের ফলে মিলিয়ারি যক্ষ্মা (miliary tuberculosis) দেখা দেয়। এ জাতীয় যক্ষ্মায় মস্তিষ্কের আবরনী আক্রান্ত হলে মেনিনজাইটিস যক্ষ্মা নামক মারাত্মক রোগের প্রকোপ ঘটে।

শত শত বছর ধরে যক্ষ্মা দুনিয়াজোড়া অন্যতম প্রধান ঘাতক ব্যাধি হয়ে আছে। এখনও এটি অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। একাধিক ঔষধ (multidrug) প্রতিরোধক্ষম জীবাণু উৎপত্তির আগে ১৯৯০ সালের দিকে যক্ষ্মা যথেষ্টই হ্রাস পেয়েছিল। গৃহহীন, উদ্বাস্ত্ত ও জেলখানার কয়েদিদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অধিক। গত শতকে কেবল যক্ষ্মা রোগেই ২০ কোটির বেশি লোক মারা গেছে। বর্তমানে যক্ষ্মা বিস্তারের হার হলো প্রতি সেকেন্ডে ১ জন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে দৈনিক ২০০০ লোকের মৃত্যু। এক হিসাব থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশে প্রতি ২ মিনিটে ১ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি ১০ মিনিটে ১ জন মারা যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী এই ভয়ানক রোগের কারণে বার্ষিক মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ৫২,০০০ এবং এই সংখ্যাটি আধিক্যের হিসাবে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। প্রতিরোধযোগ্য এই রোগে বছরে ৩ লক্ষাধিক মানুষ সংক্রমিত হয় এবং হারটি প্রতি ১ লক্ষে ১১১ জন। দশ বছর আগে প্রতি ১ লক্ষে সংক্রমণের হার ৪০ থেকেও কম ছিল।

১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরী সহায়তায় বিশ্ব ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রম (NTP) শুরু হয় এবং আজ পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৮০০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদের ৮০ শতাংশেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসার সাহায্যে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এই সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগের পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক, কেননা দেশে রয়েছে অত্যধিক জন ঘনত্ব, নিম্নমানের আবাসন, দারিদ্র ও শিক্ষার নিম্ন হার।

১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যক্ষ্মা একটি ‘বিশ্ব সংকট’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ায় অত্যধিক যক্ষ্মাক্রান্ত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যক্ষ্মারোগ বিস্তার রোধে Directly Observed Treatment/DOTS- Short Course নামে সাধারণ্যে পরিচিত ঔষধের তদারকমূলক হস্তক্ষেপের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি একটি সাশ্রয়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৬৪-১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় পর্যায়ে যক্ষ্মারোগের উপর অনুষ্ঠিত জরিপ থেকে জানা যায় যে জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% যক্ষ্মার সাধারণ ধরন, প্রধানত শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত ফুসফুসীয় যক্ষমায় কমবেশি আক্রান্ত। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে বিসিজি টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে এই অঞ্চলে যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে পুরোনো ঢাকার নীমতলিতে একটি যক্ষ্মা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সংগঠিত যক্ষ্মা চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে বিভাগীয় সদরে আরও ৩টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জেলাসদরের হাসপাতাল, ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত জাতীয় যক্ষ্মাকার্যক্রম ক্লিনিক, চাঁনখারপুল এলাকায় যক্ষ্মা নিরাময় ও নিয়ন্ত্রন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও মহাখালীর জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রমের সদর দপ্তরে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে।

জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রমের অধীনে ১৯৯৩-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্যারামেডিকসহ ৩০ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে যক্ষ্মা শনাক্তি ও রোগনির্ণয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ব্র্যাক, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন, ডেনিশ-বালাদেশ লেপ্রসি মিশন (DBLM), স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিসেস (RDRS), ন্যাশনাল অ্যান্টিটিবি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (NATAB) ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। কার্যকর উপদেশমূলক সতর্কতার উপর যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এই কর্মসূচিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসক, উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলির অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ সফল যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। [এস.এম হুমায়ুন কবির]

আরও দেখুন যক্ষ্মা নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট