মহাস্থবির, সাধনানন্দ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মহাস্থবির, সাধনানন্দ (১৯২০-২০১২)  বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক গুরু। জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯২০, রাঙ্গামাটির সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নে। তাঁর পারিবারিক নাম রথীন্দ্র চাকমা, সাধনানন্দ তাঁর অর্পিত নাম। তবে তিনি সমধিক পরিচিত ‘বনভান্তে’ নামে ।

রথীন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় একটি প্রাইমারী স্কুলে। কিন্তু পিতাকে তাঁর সাংসারিক কাজে সাহায্য করতে গিয়ে তাকে ওই প্রাইমারিতেই পড়ালেখার ইতি টানতে হয়। রথীন্দ্র স্কুল ছেড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বই পড়তে তিনি খুবই ভালোবাসতেন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতি তার ছিল গভীর আগ্রহ। ১৯৪৩ সালে তাঁর পিতা হারু মোহনের মৃত্যু ছিল তাঁর জীবনের এক বড় আঘাত। ছয় ভাইবোনদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ হওয়ায় পরিবারের সব দায়িত্ব তাঁকে বহন করতে হয়। জানা যায়, পরিবারের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি রাঙ্গামাটির বাজার থেকে রেশম কিনে তা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতেন। ১৯৪৯ সালে, ২৯ বছর বয়সে তাঁর জীবনে এক পট-পরিবর্তন ঘটে। এসময় চট্টগ্রাম নিবাসী বাবু গজেন্দ্র লাল বড়ুয়া নামে এক চিকিৎসকের সহায়তায় তিনি চট্টগ্রাম আসেন এবং এখানকার বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মহাস্থবির দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের অধীনে ‘শ্রমণ’ অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুজীবনের শিক্ষানবিস হিসেবে জীবন শুরু করেন। তখন তার নাম হয় রথীন্দ্র শ্রমণ।

শুরু থেকেই বৌদ্ধ সন্ন্যাস জীবনের সব নিয়মনীতি কঠোরভাবে মেনে চলায় খুবই নিষ্ঠাবান ছিলেন রথীন্দ্র। বিহারের অন্য শ্রমণদের মধ্যে ছিল সে নিষ্ঠার অভাব; শুধু তাই নয়, অনেকে নির্দেশিত বিধান লঙ্ঘনও করতেন নির্দ্বিধায়। এরূপ পরিস্থিতে ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে বলে তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে নিজ গ্রামের বাড়ীতে আসেন এবং ধনপাতা নামক স্থানে গভীর অরণ্যে এক নির্জন পরিবেশ তপস্যা শুরু করেন। তিনি আহার সংগ্রহের জন্য দিনে একবার বাইরে আসতেন আর বাকি সময় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন সব রকম প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে। স্থানীয় লোকজন তাঁর এ সাধনা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাঁর জন্যে অরণ্যের পাদদেশে একটি অস্থায়ী কুটির স্থাপন করেন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের ফলে তাঁর ধ্যানের স্থানটি জলমগ্ন হয়ে গেলে তিনি খাগড়াছড়ি জেলার বোয়ালখালিতে চলে যান এবং সেখানেও একইভাবে গভীর অরণ্যে ধ্যানমগ্ন থাকেন। এখানেও স্থানীয় লোকজন তাঁর তপস্যার স্থানে একটি অস্থায়ী কুটির নির্মাণ করেন।

মহাস্থবির সাধনানন্দ

১৯৬১ সালের ২৭ জুন বোয়ালখালীর রাজবিহারে তাঁকে রথীন্দ্র শ্রমণ থেকে বৌদ্ধভিক্ষুতে দীক্ষিত করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় সাধনানন্দ ভিক্ষু। বৌদ্ধভিক্ষু হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে বিশ বছর সন্ন্যাসব্রত পালন করার পর রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারের এক বৌদ্ধভিক্ষু সম্মেলনে সাধনানন্দ ভিক্ষুকে মহাস্থবির পদে অভিষিক্ত করা হয়।

বোয়ালখালিতে দশ বছর অবস্থানের পর সাধনানন্দ ১৯৭০ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে চলে আসেন এবং তিনটিলা নামক স্থানে গভীর অরণ্যে তাঁর আবাস স্থির করেন। এ তিনটিলা থেকেই বৌদ্ধভিক্ষু হিসেবে তাঁর বিশেষত্ব। জীবনের মাহাত্ম্য, গভীর অরণ্যে ধ্যানমগ্ন থাকার অবিশ্বাস্য কাহিনী ও বৌদ্ধধর্মে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে। তখন থেকেই সাধনানন্দ ‘বনভান্তে’ নামে বেশি পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন।

চাকমা রাজা ও রাজপরিবারের বিশেষ আগ্রহ ও সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে বনভান্তেকে লংগদু থেকে রাঙ্গামাটিতে নিয়ে আসা হয় এবং রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। বনভান্তে সর্বস্তরের মানুষের এমন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন যে, তাঁর সাক্ষাৎ ও আশীর্বাদ লাভের জন্য প্রতিদিন রাজবনবিহারে বয়স, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য দর্শনার্থীদের ভীড় লেগেই থাকতো। দীর্ঘদিন গভীর সাধনা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সন্ন্যাসজীবন পালনের মধ্য দিয়ে বনভান্তে অর্হত্ব লাভ করেছেন বলে মনে করা হয়। যিনি অর্হত্ব লাভ করেন তিনি সব কলুষ ও দুঃখ-ক্লেশ থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুতে নির্বাণে প্রবেশ করেন এবং ভবিষ্যতে তাঁর আর পুনর্জন্ম হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি বনভান্তে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তাঁর মরদেহ বর্তমানে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারে কৃত্রিম পদ্ধতিতে রক্ষিত আছে।  [নীরু কুমার চাকমা]