বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

Nasirkhan (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৬:৩৫, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Text replacement - "সোহ্রাওয়ার্দী" to "সোহ্‌রাওয়ার্দী")
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ  বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অন্যতম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে.এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীদের কনভেনশনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন এই দলের নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, আতাউর রহমান খান, শওকত হোসেন ও আলী আহমদ খানকে সহ-সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান (তখন কারাবন্দি), খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ.কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম-সম্পাদক, এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দল ছিল। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবরের তৃতীয় কাউন্সিল সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হিসেবে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। দলটি কল্যাণমূলক অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, যুবক ও মহিলাদের মধ্যে এই দলের অঙ্গ-সংগঠন রয়েছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগই ছিল প্রথম বিরোধী দল। দলটি জন্মলগ্নেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ৪২-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পাকিস্তানি শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি, এক মানুষ এক ভোট, গণতন্ত্র, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পূর্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে আওয়ামী লীগ মুখ্যভূমিকা পালন করে।

১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অন্য তিনটি বিরোধী দল এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মৌলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে-ই-ইসলাম পার্টি এবং হাজি মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল নিয়ে পূর্ব বাংলায় সরকার বিরোধী নির্বাচনী জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে।

২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এই ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন’ এবং ‘পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি’ ছিল এই রাজনৈতিক মঞ্চের মূল বিষয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে, যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩টি আসন। যুক্তফ্রন্টের শরিক দল আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৪৩টি আসন। যুক্তফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো লাভ করে বাকি ৭২টি আসন। পাকিস্তানি শাসনামলের ২৪ বছরের মধ্যে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক ক্ষমতায় ছিল মাত্র ২ বছর (১৯৫৬-৫৮) এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার হিসেবে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল মাত্র ১৩ মাস (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬- ১১ অক্টোবর ১৯৫৭)। এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট শরিক দল নিয়ে সরকার গঠন করে এবং আওয়ামী লীগ ছিল এই সরকারের প্রধান অংশীদার। কিন্তু ৫৬ দিনের মধ্যে ফজলুল হক সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হতে থাকে। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালের মধ্যেও আতাউর রহমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে : মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি সমস্যা আয়ত্তে আনা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি প্রদান, ভূমিহীন কৃষকদের টেস্ট রিলিফ প্রদান, ভাষা শহীদ পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান, ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা, পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষের দিন হিসেবে উদযাপন, ময়মনসিংহে পশুচিকিৎসা কলেজ, ফেঞ্চুগঞ্জে সার কারখানা, সাভারে ডেইরি ফার্ম এবং ঢাকায় চলচিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) স্থাপন। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শিল্প, বাণিজ্য এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কেন্দ্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে : পাকিস্তানের দুই প্রদেশে সকল ক্ষেত্রে সমতা আনয়ন, পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন প্রথম বারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠান, জাতীয় সংসদে যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা (অক্টোবর ১৯৫৬) প্রবর্তনের আইন পাসকরণ, পাট বাজারজাতকরণ, অভ্যন্তরীণ জল পরিবহন সংস্থা (আইডব্লিউটিএ) এবং পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংস্থা (ওয়াপদা) প্রতিষ্ঠা।

১৯৫৭ সালে বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করে দলটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে দলটি মারাত্মক সাংগঠনিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী মূলত পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করে ভিন্নমত পোষণ করেন। সোহরাওয়ার্দী পাশ্চাত্যের সঙ্গে বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতি হলেও ভাসানী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। কাগমারি সম্মেলনে (টাংগাইল) দলটির (৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) বিভক্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ এবং এর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগের ফলে দলের ওয়ার্কিং কমিটির ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন ভাসানীকে সমর্থন করেন। পরিণামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নতুন দল জন্মলাভ করে এবং মওলানা ভাসানী এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে দলীয় সমর্থকদের এক সম্মেলনে দলটি রূপলাভ করে।

এই সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মাত্র নয় মাস মন্ত্রীত্ব করার পর আওয়ামী লীগে পূর্ণকালীন সময় দেয়ার জন্য তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ (৩১ মে ১৯৫৭) করেন। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরাচারি শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন লাভের সংগ্রামে প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুর পূর্বে এইচ এস সোহরাওয়ার্দী প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে আইয়ুব বিরোধী একটি মোর্চা গঠন করেন। এই ফ্রন্ট গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুদ্ধারের আহবান জানায়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে কেন্দ্রীয় সদস্যদের সভায় তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে প্রচারণার জন্য দলটি পূর্ব পাকিস্তান : রুখিয়া দাঁড়াও  নামে একটি পুস্তিকা বিতরণ করে। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব সরকারকে অপসারণের লক্ষে বেশ কিছু বিরোধী দল নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) নামে একটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করা হয়। সম্মিলিত বিরোধী দল মিস ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দান করে। কপের দাবি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার স্থলে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় পরোক্ষ ভোটের স্থলে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তন। নির্বাচনের ফলাফল জনগণের ভোট দ্বারা নয়, ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী দ্বারা নির্ধারিত হয়। ফলে বিরোধী দল স্বভাবতই পরাজয় বরণ করে।

১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৭ দিন ব্যাপী যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বাঙালিদের রক্ষার জন্য লক্ষণীয় সামরিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অনুপস্থিতির ফলে বাঙালিদের অসহায়ত্বের বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের এক সম্মেলনে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকারসহ কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন; বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ব্যতীত প্রাদেশিক সরকারের হাতে সকল প্রকার ক্ষমতা প্রদান; পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন; প্রাদেশিক সরকারের হাতে কর ও শুল্ক আদায়ের অধিকার ন্যস্তকরণ; প্রাদেশিক সরকারের হাতে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান; এবং সবশেষে, নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য প্রদেশগুলোকে আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা প্রদান।

ছয়দফা কর্মসূচি রাজনীতিতে পরিবর্তন সাধন করে। এই কর্মসূচির প্রতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র এবং অনেকেই সরাসরি এই কর্মসূচির বিরোধিতা করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই একটি অংশ ছয়দফা দাবি সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্য ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি অনুমোদন করাতে সমর্থ হন। শেখ মুজিব দলের সভাপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬-দফা কর্মসূচি তাৎক্ষণিকভাবে দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ৬-দফার প্রতি আইয়ুব সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই কঠোর। আইয়ুব খান ৬-দফা কর্মসূচিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপচেষ্টা’ বলে অভিহিত করেন এবং অস্ত্রের ভাষায় এই দাবি প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু ৩ মাস ব্যাপী সারাদেশে গণ-জমায়েত কর্মসূচি শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁকে আট বার গ্রেফতার করা হয়, এবং অবশেষে ১৯৬৬ সালের ৮ মে কারাগারে বন্দি করা হয়। ৬-দফা কর্মসূচির সমর্থন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ৭ জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে  আওয়ামী লীগ আহূত সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ তেজগাঁও, টংগী ও নারায়ণগঞ্জে জনতার উপর গুলিবর্ষণ করলে ১৩ জন নিহত হয়। এরপরই সারা দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা শুরু হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগম যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার ৬-দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি ‘চূড়ান্ত সমাধান’ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ (কারাবন্দি) ৩৪ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করা হলেও সরকারিভাবে এর নামকরণ হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য এই মামলার বিরূপ ফল দেখা দেয়। এই মামলার ফলে গণআন্দোলন শুরু হয় এবং আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।

দেশব্যাপী গণআন্দোলন এবং আইয়ুব খানের পতনের প্রেক্ষাপটে নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ বাঙালিদের জন্য জাতীয়তাবাদী মঞ্চে পরিণত হয়। দলটি ৬-দফা কর্মসূচিকে প্রকৃত গণভোট হিসেবে গ্রহণ করে পূর্ণ শক্তি ও উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২ টি আঞ্চলিক আসনের (৭২.৫৭% ভোট) মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের (৮৯% ভোট) মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলটি জাতীয় পরিষদেও মোট ৭টি মহিলা আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের মোট ১০টি মহিলা আসনের সবগুলো আসনেই জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং আওয়ামী লীগ অভিন্ন।

এভাবে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের আহবানের পরিবর্তে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা নির্বাচনের রায় বাতিল ও বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করার জন্য সামরিক বাহিনী তলব করে। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলনের ডাক দেন এবং দেশবাসী তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র্র প্রতিরোধ আন্দোলনের উদাত্ত আহবান জানান। তিনি ঘোষণা করেন : ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর রাতে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন) এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। এই প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।

১৯৭২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (১৯৭২-৭৫) এবং পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে (১৯৯৬-২০০১) দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন ছিল। প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এ সময় সরকারকে শুরু থেকেই সবকিছুকে পুনর্গঠন করতে হয়েছিল। বেসামরিক লোকের হাতে বিপুল সংখ্যক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকার ফলে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর মধ্যে ছিল : মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন; ১০ মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন (১৯৭২); মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সৈন্যদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানো; নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্য বিশ্বের ১৪০ টি দেশের স্বীকৃতি লাভ; ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত এক কোটি শরণার্থী এবং যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা ধর্ষিত প্রায় তিন লক্ষ নারীর পুনর্বাসন। স্বাধীনতালাভের ১৫ মাসের মধ্যে নতুন সংবিধান অনুসারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল আওয়ামী লীগের আরেকটি অর্জন। নির্বাচনে (মার্চ ১৯৭৩) আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ টি আসন (৭৩.১৭% ভোট) লাভের মধ্য দিয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, অব্যাহত দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অসমাপ্ত বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করার কারণে চরম বামপন্থী দলসমূহ সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এসব দল গুপ্তভাবে সশস্ত্র লোকজন এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দুঃসাহসিক পদক্ষেপ হিসেবে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয় (১৯৭৪) এবং চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থলে একটি মাত্র জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর অধীনে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। আওয়ামী লীগসহ সকল দল সরকারিভাবে বিলুপ্ত করা হয়। এই নতুন ব্যবস্থায় কঠিন আইন প্রয়োগ করে সরকারি সংবাদপত্র ব্যতীত সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা সহ নাগরিক অধিকার সীমিত করা হয়।

এসব নেতিবাচক ঘটনাবলির সুযোগ গ্রহণ করে কিছু অসন্তুষ্ট অধস্তন সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে ঢাকায় বসবাসরত পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করে। অচিরেই আরেকটি আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে চারজন শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। অধিকন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল প্রবিধানের অধীনে দলটি পুনরুজ্জীবিত (১৯৭৬) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দলে পুনরায় ভাঙ্গন দেখা দেয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক বাহিনী কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনোবা বেসামরিক ছদ্মাবরণে ১৫ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে। রাজনৈতিক কারণে ক্ষমতা জবরদখলকারিরা বিভিন্ন উপায়ে আওয়ামী লীগকে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও টিকে আছে। আওয়ামী লীগ কখনো এককভাবে আবার কখনো সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যজোট করে জিয়া-সাত্তার-এরশাদের শাসনামলের সকল রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। একদিকে দলকে ঐক্যবদ্ধ, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার জন্য দলটি নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। আওয়ামী বিরোধী শাসনামলে অনেক সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও আওয়ামী লীগ ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে কাজ করে এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ৩৯টি আসন (২৪.৫৫%) লাভ করে। নির্বাচনের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫-১৯৭৯ পর্যন্ত তাঁর সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ভিতরে ও বাইরে সর্বাত্মক বিরোধিতা করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছয় বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এর পূর্বে বিদেশে অবস্থানকালে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ১৯৮৩ সালের প্রথমদিকে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। এই ঐক্যজোট ৫-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে যার উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে : সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা এবং অন্য কোনো নির্বাচনের পূর্বে সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই কঠিন ও সংকটময় মুহূর্তে দলটি ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়। ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) প্রতি বিশ্বাসী ও অনুগত বিপুল সংখ্যক দলীয় নেতা ও কর্মি দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নতুন পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বাকশালের আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে। কিন্তু দলের সংখ্যাগরিষ্ট কর্মীবৃন্দ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। অবশ্য ১৯৯১ সালে বিভক্ত বাকশালের অধিকাংশ সদস্য মূলধারায় ফিরে আসেন।

এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। অবিরাম আন্দোলনে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অনেক হরতাল ডাকা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) সহযোগী হিসেবে নিতে রাজি হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিরোধী দলের দাবির কাছে পরাজয় স্বীকার করে ১৯৮৬ সালের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে।

স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে ১৫-দলীয় ঐক্যজোটে ভাঙ্গন দেখা দেয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) পরিচালিত ৭ দলীয় ঐক্যজোট রাজপথের আন্দোলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু আওয়ামী লীগ পরিচালিত সহযোগিরা এই সিদ্ধান্তকে অবিবেচনা প্রসূত মনে করে। অবশেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮-দলীয় ঐক্যজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ৯৭টি আসন লাভ করে এবং ভোট পড়ে ৩১.২১% (আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭৬টি আসন লাভ করে এবং ভোট পায় ২৬.১৫%)। অবশ্য রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদ কর্তৃক জাতীয় সংসদ অবলুপ্ত ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ তৎকালীন সরকার আরেকটি নির্বাচন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সহ প্রধান দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে।

সরকারের বিরুদ্ধে বিরামহীন বিরোধিতার কারণে এরশাদ ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে (৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪০ টি আসন এবং ৩০.৮১% ভোট) সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী দলগুলো অধিকাংশ ভোট পেলেও কম আসন সংখ্যা লাভ করে (৩৪.২৯% ভোট এবং ১০০টি আসন; আওয়ামী লীগ এককভাবে লাভ করে ৮৮টি আসন এবং ভোট পায় ৩০.০৮%)।

আওয়ামী লীগ মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট থেকে এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়। অবশ্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এরূপ সমঝোতা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি। মিরপুর (ঢাকা) এবং মাগুরার (যশোর) উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অচিরেই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। উভয় উপ-নির্বাচনে সরকার দলীয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অ-জনপ্রিয় প্রার্থীর জয়লাভ এবং নির্বাচন পরিচালনা পদ্ধতি বিরোধী দলকে এই বিশ্বাসে উপনীত করে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ ও স্বাধীন হবে না। এভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রথমে জাতীয় সংসদ বর্জন (মার্চ-ডিসেম্বর ১৯৯৪), এবং পরবর্তীকালে সংসদ থেকে গণপদত্যাগ (২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৪) এবং ক্রমাগত হরতাল আহবান করে। বিএনপি সরকার এই দাবি উপেক্ষা করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬), কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী দলসমূহ এই নির্বাচন সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচনের ফলাফল জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। জনগণ এই নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করে। এভাবে সৃষ্ট জাতীয় সংসদ মাত্র ৪ দিন স্থায়ী হয়। জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি স্বীকার করে নেন। বিরোধী দলের সমর্থনে তিনি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর তিনি ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করেন।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে (৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪৬টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৩৭.৫৩%) জয়লাভ করে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন। তাঁর সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই সরকারের অবদানের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদকে শক্তিশালী করা (মন্ত্রীদের পরিবর্তে জাতীয় সংসদের সদস্যদের কমিটি সভাপতি নির্বাচিত করা); প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রবর্তন; ‘ইনডেমনিটি আইন’ বাতিল (২ নভেম্বর ১৯৯৬) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচারের পথ সুগমকরণ; ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষর (১২ ডিসেম্বর ১৯৯৬); পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (২ ডিসেম্বর ১৯৯৭) সম্পাদন; ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মহিলাদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাসহ নারীর ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ; দারিদ্র্য হ্রাসকরণ এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ; বয়স্ক, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ও বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তার পদক্ষেপ গ্রহণ; সুবিধা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক অনুদান প্রদান; খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি। তাঁর শাসনামলে বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামাত সমর্থিত চারদলীয় জোটের নিকট আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন এবং ৪০.১৩% ভোট পায়, অন্যদিকে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন এবং ৪০.৯৭% ভোট (চার দলীয় জোট ২১৬ আসনে জয়লাভ করে এবং ভোট পায় ৪৭.০৫%)।

কিন্তু এই বিপর্যয় সত্ত্বেও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়া সরকারের (১৯৯৬-২০০১) সকল প্রকার দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে।  এ ছাড়া জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনও আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করে। বিএনপি জোট সকল প্রকার নিয়মতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং সংবিধান আংশিক কার্যকর রাখে। উভয় বৃহত্তর দলের নেতাদের কারাবন্দি করা হয়। এরূপ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সেনাবাহিনী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কে জাতীয় রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করবে। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা’ নামে পরিচিত এই পরিকল্পনা সেনা সমর্থিত সরকারের নিকট অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বলে প্রমাণিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও জেনারেল মইন ইউ আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিল। মনে হয় তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দুই প্রধান নেত্রীকে গ্রেফতার এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার; ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র নামে ঐ দুই জনকে স্থায়ীভাবে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা; রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাব; রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী নেতাদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার; শাসকমুখী দল (প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি) গঠন ইত্যাদি ঘটনাবলি সেনা সমর্থিত শাসনকে দীর্ঘায়িত করার পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু তারপরও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬২টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৫৫.৮৫% ভোট লাভ করে (এককভাবে আওয়ামী লীগ ৪৮.২৯% ভোটসহ ২৩০টি আসন লাভ করে)।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত জোট সরকার গঠন করে। নতুন সরকারের নিকট সবচেয়ে দুঃখজনক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে রক্তক্ষয়ী বিডিআর বিদ্রোহ যা সরকার গঠনের তিন সপ্তাহের মধ্যে সংঘটিত হয়। সরকার বিদ্রোহ-উত্তর ঘটনাবলি সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রন করতে সমর্থ হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ের অন্যান্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছে: প্রথমবারের মতো সংসদীয় কমিটি গঠন করে সংসদ সদস্যদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা; বিচারবিভাগের চূড়ান্ত রায় অনুসারে জাতির জনক হত্যার ৫ জন হত্যাকারীর বিচার সম্পন্ন করা; ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা; ইসলামি জঙ্গিসহ অন্যান্য জঙ্গিদের কার্যক্রম সীমিত করা; জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করা সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ।  [হারুন-অর-রশীদ]