দেশবিভাগের রাজনীতি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
(Text replacement - "সোহ্রাওয়ার্দী" to "সোহ্‌রাওয়ার্দী")
 
৮ নং লাইন: ৮ নং লাইন:
বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকেরা সবচেয়ে শক্তিশালী যে-হাতিয়ার ব্যবহার করে, তা হলো উপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও প্রযুক্ত সাম্প্রদায়িকতা। ঐতিহাসিক রাজনীতি এবং ভাবাদর্শের মাপকাঠিতে বাংলার জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা এক জটিল ও পরস্পরবিরোধী সমস্যা।
বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকেরা সবচেয়ে শক্তিশালী যে-হাতিয়ার ব্যবহার করে, তা হলো উপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও প্রযুক্ত সাম্প্রদায়িকতা। ঐতিহাসিক রাজনীতি এবং ভাবাদর্শের মাপকাঠিতে বাংলার জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা এক জটিল ও পরস্পরবিরোধী সমস্যা।


১৯৩২ সালের [[সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ|সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ]] বা বাটোয়ারা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্য-সহযোগিতাপূর্ণ। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রকে দুর্বল রেখে প্রদেশগুলিকে শক্তিশালী করা। ফলে সর্বভারতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। প্রদেশগুলিই হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এর ফলে কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের নিজস্ব নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে তাঁদের নিজ নিজ আস্থাভাজন ব্যক্তিদের প্রাদেশিক নেতৃত্বে স্থাপন করার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কে সরকারে অথবা দলে নেতৃত্ব লাভ করবেন, এম এ জিন্নাহ নেপথ্যে থেকে নির্ধারণ করে দেন। ১৯৪৩ সালে আইনসভার কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার সদস্যদের সমর্থনে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার জন্য তিনি এ. কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সমর্থন থেকে বঞ্চিত করেন। এর ফলে কৃষকপ্রজা পার্টির জনপ্রিয়তা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখেও হোসেন শহীদ  [[সোহ্রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|সোহরাওয়ার্দী]] মুসলিম লীগকে বাংলায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের নির্বাচনের পর জিন্নাহ-এর ইঙ্গিতে সোহরাওয়ার্দীকে সংসদীয় দলের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে স্থানীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দেশ বিভাগের পর সোহরাওয়ার্দী পুর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সংসদে আসন বণ্টনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বাটোয়ারার নির্বাচনে রাজনীতির চেয়ে সাম্প্রদায়িকতাই প্রাধান্য পায়। তফসিলি, ইউরোপীয় প্রমুখ স্বার্থগোষ্ঠী স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির ফলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। এর ফলে উপদলীয় কোন্দল ও ক্ষুদ্র স্বার্থ রাজনীতিতে স্থান করে নেয় এবং ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথে উপদলীয় বাদবিসংবাদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর রাজনীতিকদের উপদলীয় কোন্দলই সবচেয়ে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বণ্টনের কারণে বাংলার আইনসভায় ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের ১৩টি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন এবং তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়েন। এ অবস্থায় আইনসভায় রাজনৈতিক দলীয় পদ্ধতি বিকাশের সুযোগ ছিল সামান্যই এবং সেখানে দলের চাইতে স্বার্থগোষ্ঠীর মিলনই দেখা যেতো। ১৯৩৭ সালের আইনে অভিহিত প্রধানমন্ত্রী তাই জনগণ ও রাজনৈতিক দলের চেয়ে বরং স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের প্রতিনিধিত্ব করেন বেশি। স্বাভাবিক কারণেই, পরবর্তীকালে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক বিকাশধারাকে বাধাগ্রস্ত করে। ঐতিহাসিকভাবে, নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা নিয়ে বাংলা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনীতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু দেশবিভাগের রাজনীতি কখনোই এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নি। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু যখন অখন্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেন, তখন প্রধান কোনো রাজনীতিক দল থেকে তাঁরা তেমন সাড়া পান নি। ফলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই অবশেষে জয়যুক্ত হয়। তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারা উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থে বাংলা বিভাগের পক্ষে মত দেয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা এবং হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা-এ দুটি ভাগে বাংলার বিভাজন হয়। ঐতিহাসিক বিড়ম্বনা হচ্ছে এই, হিন্দু ও মুসলমানেরা শতকের পর শতক একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে এসেছে এবং ধর্মের বাইরে সম্প্রদায়গত সম্পর্ক, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, উৎসব, আচারপ্রথা, উৎপাদন সম্পর্ক এবং অন্যসব ক্ষেত্রে কার্যত একই মূল্যেবোধ বজায় রেখেছে।  
১৯৩২ সালের [[সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ|সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ]] বা বাটোয়ারা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্য-সহযোগিতাপূর্ণ। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রকে দুর্বল রেখে প্রদেশগুলিকে শক্তিশালী করা। ফলে সর্বভারতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। প্রদেশগুলিই হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এর ফলে কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের নিজস্ব নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে তাঁদের নিজ নিজ আস্থাভাজন ব্যক্তিদের প্রাদেশিক নেতৃত্বে স্থাপন করার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কে সরকারে অথবা দলে নেতৃত্ব লাভ করবেন, এম এ জিন্নাহ নেপথ্যে থেকে নির্ধারণ করে দেন। ১৯৪৩ সালে আইনসভার কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার সদস্যদের সমর্থনে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার জন্য তিনি এ. কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সমর্থন থেকে বঞ্চিত করেন। এর ফলে কৃষকপ্রজা পার্টির জনপ্রিয়তা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখেও হোসেন শহীদ  [[সোহ্‌রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|সোহরাওয়ার্দী]] মুসলিম লীগকে বাংলায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের নির্বাচনের পর জিন্নাহ-এর ইঙ্গিতে সোহরাওয়ার্দীকে সংসদীয় দলের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে স্থানীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দেশ বিভাগের পর সোহরাওয়ার্দী পুর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সংসদে আসন বণ্টনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বাটোয়ারার নির্বাচনে রাজনীতির চেয়ে সাম্প্রদায়িকতাই প্রাধান্য পায়। তফসিলি, ইউরোপীয় প্রমুখ স্বার্থগোষ্ঠী স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির ফলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। এর ফলে উপদলীয় কোন্দল ও ক্ষুদ্র স্বার্থ রাজনীতিতে স্থান করে নেয় এবং ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথে উপদলীয় বাদবিসংবাদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর রাজনীতিকদের উপদলীয় কোন্দলই সবচেয়ে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বণ্টনের কারণে বাংলার আইনসভায় ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের ১৩টি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন এবং তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়েন। এ অবস্থায় আইনসভায় রাজনৈতিক দলীয় পদ্ধতি বিকাশের সুযোগ ছিল সামান্যই এবং সেখানে দলের চাইতে স্বার্থগোষ্ঠীর মিলনই দেখা যেতো। ১৯৩৭ সালের আইনে অভিহিত প্রধানমন্ত্রী তাই জনগণ ও রাজনৈতিক দলের চেয়ে বরং স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের প্রতিনিধিত্ব করেন বেশি। স্বাভাবিক কারণেই, পরবর্তীকালে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক বিকাশধারাকে বাধাগ্রস্ত করে। ঐতিহাসিকভাবে, নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা নিয়ে বাংলা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনীতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু দেশবিভাগের রাজনীতি কখনোই এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নি। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু যখন অখন্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেন, তখন প্রধান কোনো রাজনীতিক দল থেকে তাঁরা তেমন সাড়া পান নি। ফলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই অবশেষে জয়যুক্ত হয়। তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারা উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থে বাংলা বিভাগের পক্ষে মত দেয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা এবং হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা-এ দুটি ভাগে বাংলার বিভাজন হয়। ঐতিহাসিক বিড়ম্বনা হচ্ছে এই, হিন্দু ও মুসলমানেরা শতকের পর শতক একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে এসেছে এবং ধর্মের বাইরে সম্প্রদায়গত সম্পর্ক, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, উৎসব, আচারপ্রথা, উৎপাদন সম্পর্ক এবং অন্যসব ক্ষেত্রে কার্যত একই মূল্যেবোধ বজায় রেখেছে।  


হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি এবং তাদের সম্প্রদায়গত জীবন সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ঘোষণার সময় থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকে এবং পনের বছরের মধ্যে বাংলার রাজনীতি দেশবিভাগের মাধ্যমে দুটি সাম্প্রদায়িক ধারায় ভাগ হয়ে যায়। এই সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ক্ষেত্রে হিন্দু [[ভদ্রলোক|ভদ্রলোক]] এবং মুসলমান আশরাফ শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাদের প্রচারিত অর্ধসত্য এবং ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাল্পনিক সমস্যার সমাধানকল্পে জনসাধারণ দেশবিভাগের রাজনীতি মেনে নেয়। এর প্রমাণ, দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার রাজনীতি। [সিরাজুল ইসলাম]
হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি এবং তাদের সম্প্রদায়গত জীবন সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ঘোষণার সময় থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকে এবং পনের বছরের মধ্যে বাংলার রাজনীতি দেশবিভাগের মাধ্যমে দুটি সাম্প্রদায়িক ধারায় ভাগ হয়ে যায়। এই সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ক্ষেত্রে হিন্দু [[ভদ্রলোক|ভদ্রলোক]] এবং মুসলমান আশরাফ শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাদের প্রচারিত অর্ধসত্য এবং ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাল্পনিক সমস্যার সমাধানকল্পে জনসাধারণ দেশবিভাগের রাজনীতি মেনে নেয়। এর প্রমাণ, দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার রাজনীতি। [সিরাজুল ইসলাম]

১৫:৫৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

দেশবিভাগের রাজনীতি  বাংলাকে ১৯০৫ সালে একবার এবং ১৯৪৭ সালে আরেকবার ভাগ করে। প্রথম বঙ্গভঙ্গ ছয় বছরের মধ্যে বাতিল হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিভাগটি বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে। দুটি বিভাজনই ব্যর্থ হওয়ায় বোঝা যায় যে, বিভাগটা ঐতিহাসিক বিকাশের স্বাভাবিক পরিণতি ছিল না- তা ছিল উপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফল। প্রথম বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য ছিল ভৌগোলিক ও সম্প্রদায়গতভাবে বাঙালিদের বিভক্ত করে উপনিবেশিক নিয়ন্ত্র্রণ বজায় রাখা এবং উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করা। কিন্তু এটি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। প্রতিবাদের ঝড়ের মুখে ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে তা রদ হয়।

বাংলা দ্বিতীয়বার ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ উত্থানের কারণে। পুর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের পূর্বাংশরূপে এবং ঐতিহাসিক নাম বাংলা মুছে দিয়ে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। এ বিভাজনের ভিত্তি ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদ। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদের অসঙ্গতি হলো, পশ্চিমবঙ্গ যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমানের এবং একইভাবে পুর্ব পাকিস্তান যথেষ্ট সংখ্যক হিন্দুর বাস ছিল। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ঐতিহাসিক বাংলার বিভাজনটা প্রকৃতই ছিল ব্যাপক অসঙ্গতির বিষয়। তাছাড়া বাংলায় হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তাদের ন্যায্য প্রাপ্য অস্বীকৃত হয়। এই অসঙ্গতি দূর হয় প্রথমত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ প্রতিরোধ আন্দোলনে এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে।

১৯০৫ এবং ১৯৪৭ সালের ঘটনাদু’টি যে-রাজনীতির ফলে সংঘটিত হয়, সমকালীন রাষ্ট্রবিদ, ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা তা নানা  দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। তবে সবাই এ বিষয়ে একমত যে, দুই বিভাজনের কারণ যে-উপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তার সঙ্গে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল কম। সাম্রাজ্যিক নীতিনির্ধারকগণ ভারতের জনগণের সামাজিক, রাজনীতিক, ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বাস্তবতাকে চিহ্নিত করেন। এইসব বৈষম্য উপনিবেশিক সাম্রাজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহার করেন।

বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকেরা সবচেয়ে শক্তিশালী যে-হাতিয়ার ব্যবহার করে, তা হলো উপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও প্রযুক্ত সাম্প্রদায়িকতা। ঐতিহাসিক রাজনীতি এবং ভাবাদর্শের মাপকাঠিতে বাংলার জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা এক জটিল ও পরস্পরবিরোধী সমস্যা।

১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বা বাটোয়ারা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্য-সহযোগিতাপূর্ণ। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রকে দুর্বল রেখে প্রদেশগুলিকে শক্তিশালী করা। ফলে সর্বভারতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। প্রদেশগুলিই হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এর ফলে কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের নিজস্ব নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে তাঁদের নিজ নিজ আস্থাভাজন ব্যক্তিদের প্রাদেশিক নেতৃত্বে স্থাপন করার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কে সরকারে অথবা দলে নেতৃত্ব লাভ করবেন, এম এ জিন্নাহ নেপথ্যে থেকে নির্ধারণ করে দেন। ১৯৪৩ সালে আইনসভার কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার সদস্যদের সমর্থনে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার জন্য তিনি এ. কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সমর্থন থেকে বঞ্চিত করেন। এর ফলে কৃষকপ্রজা পার্টির জনপ্রিয়তা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখেও হোসেন শহীদ  সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে বাংলায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের নির্বাচনের পর জিন্নাহ-এর ইঙ্গিতে সোহরাওয়ার্দীকে সংসদীয় দলের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে স্থানীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দেশ বিভাগের পর সোহরাওয়ার্দী পুর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সংসদে আসন বণ্টনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বাটোয়ারার নির্বাচনে রাজনীতির চেয়ে সাম্প্রদায়িকতাই প্রাধান্য পায়। তফসিলি, ইউরোপীয় প্রমুখ স্বার্থগোষ্ঠী স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির ফলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। এর ফলে উপদলীয় কোন্দল ও ক্ষুদ্র স্বার্থ রাজনীতিতে স্থান করে নেয় এবং ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথে উপদলীয় বাদবিসংবাদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর রাজনীতিকদের উপদলীয় কোন্দলই সবচেয়ে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বণ্টনের কারণে বাংলার আইনসভায় ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের ১৩টি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন এবং তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়েন। এ অবস্থায় আইনসভায় রাজনৈতিক দলীয় পদ্ধতি বিকাশের সুযোগ ছিল সামান্যই এবং সেখানে দলের চাইতে স্বার্থগোষ্ঠীর মিলনই দেখা যেতো। ১৯৩৭ সালের আইনে অভিহিত প্রধানমন্ত্রী তাই জনগণ ও রাজনৈতিক দলের চেয়ে বরং স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের প্রতিনিধিত্ব করেন বেশি। স্বাভাবিক কারণেই, পরবর্তীকালে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক বিকাশধারাকে বাধাগ্রস্ত করে। ঐতিহাসিকভাবে, নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা নিয়ে বাংলা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনীতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু দেশবিভাগের রাজনীতি কখনোই এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নি। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু যখন অখন্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেন, তখন প্রধান কোনো রাজনীতিক দল থেকে তাঁরা তেমন সাড়া পান নি। ফলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই অবশেষে জয়যুক্ত হয়। তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারা উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থে বাংলা বিভাগের পক্ষে মত দেয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা এবং হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা-এ দুটি ভাগে বাংলার বিভাজন হয়। ঐতিহাসিক বিড়ম্বনা হচ্ছে এই, হিন্দু ও মুসলমানেরা শতকের পর শতক একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে এসেছে এবং ধর্মের বাইরে সম্প্রদায়গত সম্পর্ক, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, উৎসব, আচারপ্রথা, উৎপাদন সম্পর্ক এবং অন্যসব ক্ষেত্রে কার্যত একই মূল্যেবোধ বজায় রেখেছে।

হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি এবং তাদের সম্প্রদায়গত জীবন সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ঘোষণার সময় থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকে এবং পনের বছরের মধ্যে বাংলার রাজনীতি দেশবিভাগের মাধ্যমে দুটি সাম্প্রদায়িক ধারায় ভাগ হয়ে যায়। এই সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ক্ষেত্রে হিন্দু ভদ্রলোক এবং মুসলমান আশরাফ শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাদের প্রচারিত অর্ধসত্য এবং ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাল্পনিক সমস্যার সমাধানকল্পে জনসাধারণ দেশবিভাগের রাজনীতি মেনে নেয়। এর প্রমাণ, দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার রাজনীতি। [সিরাজুল ইসলাম]