বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪ কার্যকর করা হয় ১৯০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এর পটভূমি সিমলায় অনুষ্ঠিত ১৯০১ সালের শিক্ষা সম্মেলনের আলোচনা ও ১৯০২ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশমালা।

সমকালীন উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যাবলির সমাধান বের করার লক্ষ্যে ব্যাপক তদন্তের ফল ছিল এ আইন। ১৮৫৭ সালে পাসকৃত মূল বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রধানত পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রি প্রদানকারীরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার সীমা নির্দেশ করা হয়েছিল। ১৯০৪ সালের এ আইনের ক্ষমতা সংশোধন ও সংহত করার চেষ্টা করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্রদের পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ বলে এ আইন সুপারিশ করে।

আলোচ্য আইনে প্রস্তাবিত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকান্ড সম্প্রসারণ সংশ্লিষ্ট। এ আইনের তৃতীয় অনুচ্ছেদ ছিল নিম্নরূপ: বিশ্ববিদ্যালয় (অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে) ছাত্রদের পাঠদানের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও প্রভাষক নিয়োগ, শিক্ষাসংক্রান্ত দান গ্রহণ ও তার ব্যবস্থাপনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও জাদুঘর স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ, ছাত্রদের আবাস ও আচরণ সম্পর্কিত নিয়মাবলি তৈরি এবং পূর্ববর্তী আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সব কাজ করার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকবে এবং এ আইন জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের ব্যবস্থা করার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

পূর্বের ১৮৫৭-এর আইনের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শুধু জ্ঞান-পরীক্ষা ও পুরস্কৃত করার প্রতিষ্ঠান। ১৯০৪ সালের আইনে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের পাঠদান ও জ্ঞানচর্চা এবং গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত হয়। আবার পূর্বের আইনে মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়াদিতে ছাত্রদের দক্ষতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা ছিল না। এ আইনে স্পষ্টভাবে অধিভুক্ত কলেজগুলি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এগুলিকে শিক্ষাদান কেন্দ্র রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এটা সত্য যে, অধিভুক্ত কলেজগুলি কোন পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাদান করবে তা এ আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, এ ধরনের কলেজগুলি ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাদান করবে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উচ্চতর জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

এ আইনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের আকার সম্পর্কিত। পূর্বের ১৮৫৭-এর আইনের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোগণ আজীবন সদস্য রূপে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। ফেলোদের সর্বোচ্চ কোন বয়সসীমা না থাকায় সিনেটের গঠন অত্যন্ত অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। ১৯০৪ সালের নতুন আইন ফেলোদের সংখ্যা সর্বোচ্চ একশত এবং তাঁদের মেয়াদ পাঁচ বছরে সীমিত করার প্রস্তাব করে এ সমস্যার সমাধান করে। এ আইন নির্বাচনের নীতিও প্রবর্তন করে, যার দ্বারা পুরাতন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ জন ফেলো ও অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জন ফেলো নির্বাচিত হতে পারতেন।

সিন্ডিকেটগুলিকে সংবিধিবদ্ধ স্বীকৃতি দান করা হয়েছিল এবং এ আইনে শিক্ষকদের স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। অনুরূপভাবে পরিবর্তিত অবস্থায় কলেজসমূহের অধিভুক্তিকরণের নির্দেশক বিধিসমূহও কঠোর করা হয়। সিন্ডিকেটকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর অধিভুক্ত কলেজগুলি পরিদর্শন করতে হতো, যার ফলে দক্ষতার যথাযথ মান কার্যকর হয়। কলেজগুলির অধিভুক্তিকরণে বা অধিভুক্তি বাতিলে তখন থেকে সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হতো।

পূর্বের ১৮৫৭-এর আইনের অধীনে সিনেট ছিল আইন প্রণয়নের একমাত্র সংস্থা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের শুধু ‘ভেটো’ প্রয়োগের ক্ষমতা ছিল। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সিনেট কর্তৃক প্রণীত বিধিগুলি অনুমোদনের সময় সরকারকে সংযোজন বা পরিবর্তন, এমন কি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিনেট ব্যর্থ হলে নতুন বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সবশেষে, এ আইন গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আঞ্চলিক সীমানা নিরূপণের ক্ষমতা দান করেছিল।

১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন অবশ্য ১৯০৬ সালের শেষভাগের আগে কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। তখনই বিধিগুলি প্রণীত ও গৃহীত হয়। বিধিগুলি প্রণয়নের সময় আবার যারা পুরাতন রীতিতে অভ্যস্ত তাদের এবং এ আইনের উদার ধারাগুলি থেকে সুবিধা লাভ করা যাবে এ ধারণায় বিশ্বাসী অন্যদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত করে। শেষ পর্যন্ত একটি সুস্থ আপোস-মীমাংসা সম্ভব হয় এবং ১৯০৬ সালে উপাচার্য রূপে নিযুক্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পরবর্তী দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন ও কর্মকান্ডে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করতে সক্ষম হন। তিনি গুরুত্ব আরোপ করে এ অভিলাষ ব্যক্ত করেন যে, জ্ঞান বিতরণই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়, জ্ঞান আহরণ ও তার সংরক্ষণও বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিকারের কাজ।

ভারতীয় জনমত অবশ্য এ আইন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ছিল। তারা আশঙ্কা করেছিল যে, সংস্কারের অজুহাতে সরকার বাস্তবে ইউরোপীয় শিক্ষাবিদদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছেন। তারা এটাও আশঙ্কা করেছিল যে, উচ্চশিক্ষার অগ্রগতিতে ভারতীয় বেসরকারি উদ্যোগের সক্রিয় ভূমিকা পালনের পথে এটা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।

এসব আশঙ্কা অবশ্য অমূলক প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯০৪ সালোত্তর কালে সিনেট ও সিন্ডিকেটের সভা আরও ঘন ঘন অনুষ্ঠিত হয় এবং অধিভুক্ত কলেজগুলির পরিদর্শন আরও নিয়মিত হয়। ১৯০৪ সালের পরে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত কলেজের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। উপরন্তু, অধিভুক্তির কঠোরতর বিধিগুলি কলেজে পাঠদানে দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।

এ আইন ভারত সরকারকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রথমবারের মতো অনুদান দেওয়ার বিধান করা হয়। ১৯০৪ সালের আগে পাঞ্জাব ছাড়া অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন সরকারি অনুদান মঞ্জুর করা হতো না। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্য ও আইন বিষয়ে পাঠদানের জন্য বছরে প্রায় ৩০,০০০ টাকা পেত। এ আইন বাস্তবায়নের পর ভারত সরকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে পাঁচ বছরের জন্য বার্ষিক ৫,০০,০০০ টাকা অনুদান ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ওপর সরকারের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ থাকলেও ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধনে সফল হয়েছিল। তেরো বছর পরে স্যাডলার কমিশন এ প্রসঙ্গে বলে যে, ‘এ আইন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পূর্ণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিল’।  [রচনা চত্রবর্তী]