বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭-ক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি নতুন ‘জাতীয় দল’ গঠন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যা একদিকে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংঘটিত নানাবিধ অনাচার প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেবে, অন্যদিকে যুদ্ধের ধ্বংসস্ত্তপের ওপর জাতি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবে। এরূপে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দল গঠন করে এর নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (সংক্ষেপে বাকশাল)। বাকশালের বিধিবিধানে বিভিন্ন সরকারি চাকুরে ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অপরাপর সব দল ও সংগঠনকে জাতীয় দলে যোগ দিয়ে অপশক্তির মোকাবেলা করা এবং দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বলা হয়। বাকশালের বিভিন্ন দিক, কার্যক্ষেত্র এবং সম্ভাবনা সবিস্তারে বর্ণনা করে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই উদ্যোগকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বিধান রাখা হয় যে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাকশালে যোগদান না করে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য পদে বহাল থাকতে পারবেন না। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন ও সংস্থার স্থলে একক দল হিসেবে নবগঠিত জাতীয় দল বাকশাল ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারিভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। বাকশাল পদ্ধতির বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে একটি ছিল সংবাদপত্র অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জারিকৃত এই অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশনার ব্যবস্থা রেখে অন্য সব পত্রপত্রিকা প্রকাশের অনুমতি বাতিল করা হয়।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান জাতীয় দলের জন্য ১৫ সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি মনোনীত করেন। এছাড়া জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ নামে দলের পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনকে মনোনয়ন দান করা হয়। নির্বাহী কমিটির সদস্যরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগের অধিকারী ছিলেন।
দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণমুখী করার লক্ষ্যে ঢেলে সাজানোই ছিল বাকশাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। বাকশালের একটি বড় লক্ষ্য ছিল দেশের প্রভাবশালী আমলাতন্ত্রের সংস্কার সাধন। নতুন ব্যবস্থায় পুনর্গঠিত আমলাতন্ত্রকে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। এর একটি ছিল জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অপরটি জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল। এই ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রতিটি মহকুমাকে একজন নির্বাচিত গভর্নরের অধীনে জেলায় রূপান্তরের বিধান রাখা হয়। জেলার সংসদ-সদস্যগণ, বাকশালের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার বেসামরিক, পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল। গভর্নর হবেন জেলার প্রধান নির্বাহী এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হবেন গভর্নরের সচিব। উদ্দেশ্যে ছিল, জেলা গভর্নর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমূলক উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং স্বাধীনতাকে তাদের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ করে তোলা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে বাকশালের পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
একটি পদ্ধতি হিসেবে বাকশালের লক্ষ্য ছিল এমন একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন যে ব্যবস্থা আদর্শ ও প্রায়োগিক দিক থেকে কমবেশি সমকালীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অনুসৃত ব্যবস্থার কাছাকাছি।
নতুন এই ব্যবস্থায় স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী ও সুশীল সমাজের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। জনগনের যে বিপুল অংশ দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুকে গণতন্ত্রবাদী হিসেবে তাঁর ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার জন্য ব্যাপক সমর্থন দিয়ে আসছিল, কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রধান হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি তাদের কাছে মোটেও সুখকর ছিল না।
বাকশাল পদ্ধতি পূর্ণভাবে কার্যকর হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাকশাল পদ্ধতি যেমন কার্যকর হয় নি, তেমনি রহিত করাও হয় নি। এরপর বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে বাকশাল পদ্ধতি অপসারণ করা হয়। [সিরাজুল ইসলাম]