বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র (১৮৩৮-১৯০৩) কবি, আইনজীবী। ১৮৩৮ সালের ১৭ এপ্রিল হুগলির গুলিটা গ্রামে মাতামহের বাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতার আর্থিক দৈন্যের কারণে মাতামহের সহায়তায় তিনি কলকাতার খিদিরপুর বাঙ্গালা স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন। কিন্তু মাতামহের মৃত্যুর পর কিছুদিন তাঁর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর প্রচেষ্টায় তিনি ইংরেজি শেখেন এবং ১৮৫৩ সালে হিন্দু স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অর্থাভাবে তাঁর লেখাপড়া পুনরায় বন্ধ হয়ে যায় এবং কিছুদিন তিনি চাকরি করতে বাধ্য হন। ১৮৫৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি বিএ পাস করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের গ্রাজুয়েটদের অন্যতম। ১৮৬১ সালে তিনি এলএল এবং ১৮৬৬ সালে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
গ্রাজুয়েট হওয়ার আগে মিলিটারি অডিটর-জেনারেল অফিসে কেরানি পদে চাকরির মধ্য দিয়ে হেমচন্দ্রের কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি কিছুদিন ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন এবং ১৮৬২ সালে মুন্সেফ হন। এ পদে কয়েকমাস চাকরি করার পর পুনরায় তিনি ওকালতিতে ফিরে আসেন এবং ১৮৯০ সালে সরকারি উকিল নিযুক্ত হন। কর্মজীবনে হেমচন্দ্র আইনজীবী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
হেমচন্দ্রের প্রধান পরিচয় একজন দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে তিনি তাঁর রচনায় দেশপ্রেমকে তুলে ধরেন। ১৮৭২ সালের জুলাই মাসে এডুকেশন গেজেট-এ তাঁর ‘ভারতসঙ্গীত’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর প্রতি রুষ্ট হন, এমনকি পত্রিকার সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কেও এজন্য জবাবদিহি করতে হয়। এ কবিতায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতবাসীদের আহবান জানান। কবিতাটি দীর্ঘকাল বঙ্গের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় আসীন ছিল। তাঁর ‘ভারতবিলাপ’, ‘কালচক্র’, ‘রিপন উৎসব’, ‘ভারতের নিদ্রাভঙ্গ’ প্রভৃতি রচনায়ও স্বদেশপ্রেমের কথা ব্যক্ত হয়েছে।
হেমচন্দ্রের রচনায় নারীমুক্তির বিষয়টিও ব্যক্ত হয়েছে। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি তৎকালে বিধবাদের প্রতি সমাজের নির্দয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হেনেছিলেন। এ বিষয়ে রচিত তাঁর ‘কুলীন মহিলা বিলাপ’ কবিতাটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহরোধ আন্দোলনের সহায়ক হয়েছিল। তাঁর রচনায় বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত বাসভূমিরূপে চিত্রিত হয়েছে। তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে অখন্ড ভারতের স্বাধীন ও সংহতিপূর্ণ রূপ কামনা করেছিলেন।
হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ চিন্তাতরঙ্গিণী ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা হচ্ছে বৃত্রসংহার (২ খন্ড, ১৮৭৫-৭) মহাকাব্য। মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত এ কাব্যে মূলত সমসাময়িক সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় ঘোষিত হয়েছে। একসময় বাংলাদেশে কাব্যটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং কবি হিসেবে হেমচন্দ্রের যা খ্যাতি তা মূলত এ কাব্যের জন্যই। হেমচন্দ্রের অপর বিশিষ্ট কাব্য বীরবাহু কাব্য (১৮৬৪) দেশপ্রেম ও গোত্রপ্রীতির পরিচয় সম্বলিত একখানা আখ্যানধর্মী রচনা। তাঁর অপরাপর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো: আশাকানন (১৮৭৬), ছায়াময়ী (১৮৮০), দশমহাবিদ্যা (১৮৮২), চিত্তবিকাশ (১৮৯৮) ইত্যাদি।
হেমচন্দ্রের কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কবিতাবলী (২ খন্ড, ১৮৭০-৮০)। এটি তাঁর খন্ডকবিতার সংকলন। ‘জীবনসঙ্গীত’, ‘গঙ্গার উৎপত্তি’, ‘পদ্মের মৃণাল’, ‘ভারতকাহিনী’, ‘অশোকতরু’ প্রভৃতি খন্ডকবিতা তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি। এগুলির ভাব-ভাষা-ছন্দ শাশ্বত আবেদনময়। এসব খন্ডকবিতায় ইংরেজি কাব্যের ছায়া থাকলেও মাধুর্য এবং রসসৃষ্টির দিক থেকে তা বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে।
হেমচন্দ্র বেশ কিছু ইংরেজি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন। সেসবের মধ্যে শেক্সপীয়রের টেম্পেস্ট (নলিনী বসন্ত, ১৮৭০) ও রোমিও-জুলিয়েট (১৮৯৫) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি বেশ কিছু ইংরেজি কবিতারও বঙ্গানুবাদ করেন।
হেমচন্দ্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি যেমন গুরুগম্ভীর আখ্যায়িকা কাব্য রচনা করেছিলেন তেমনি আবার সহজ সুরের খন্ডকবিতা, ওজস্বিনী স্বদেশসঙ্গীত এবং লঘু সাময়িকী কবিতাও রচনা করেছিলেন। শিল্প ও সাহিত্যসহ জ্ঞানের অন্যান্য অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন গুণী ব্যক্তি হিসেবে সমকালে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষজীবন ছিল খুবই বেদনাময়। তিনি একসময় অন্ধ হয়ে যান এবং অর্থনৈতিক নানা প্রকার অসুবিধার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯০৩ সালের ২৪ মে খিদিরপুরে নিঃসহায় ও নিঃস্ব অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। [আমীনুর রহমান]