বঙ্গীয় বসতি, প্রারম্ভিক
বঙ্গীয় বসতি, প্রারম্ভিক (Settlement in Bengal, Early) বাংলায় মানব বসতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। বর্তমান সময়কালের উদ্ভিজ্জ আবরণ ও ভূদৃশ্যে কয়েক হাজার বছরের মানবীয় কর্মকান্ড ও প্রভাবের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান এবং ভূ-পৃষ্ঠে বসতির ধরন ও কৃষিকাজ থেকে এতদঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। বাংলায় বসতির ক্রমবিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ভূমির উচ্চতার বিন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, সমগ্র প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলার অধিকাংশ স্থানই ছিল হিংস্র জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ বন-জঙ্গল ও জলাভূমিতে আচ্ছাদিত। এমনকি ঐতিহাসিক সময়কালে, অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল মানুষের বিচরণের জন্য অনুপযুক্ত। পরবর্তীতে মোগল সময়কালেও গাঙ্গেয় সমভূমির বেশিরভাগ এলাকা ছিল বন-জঙ্গলে পূর্ণ এবং এসকল জঙ্গলাকীর্ণ ভূমির মধ্য দিয়ে মানুষের অনুপ্রবেশ অত্যন্ত ধীরগতিতে সংঘটিত হয়েছিল। এভাবে বলা যায় বাংলার অপেক্ষাকৃত পুরাতন ও উত্থিত ভূমিগুলোতেই আদি বসতি গড়ে উঠেছিল। বসতি বিকাশের প্রথম পর্যায়ে টারশিয়ারী পর্বতসমূহ (৬ কোটি ৬০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ বছর পূর্বেকার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা ৩০০ মি) এবং প্লাইসটোসিন সোপানসমূহ (২০ লক্ষ বছর থেকে ১ লক্ষ বছর পূর্বেকার এবং সাম্প্রতিক যুগে গঠিত ভূমির আনুভূমিক তল অপেক্ষা গড়ে ১.৫ মিটার থেকে ৬ মিটার বেশি উঁচু বরেন্দ্রভূমির পশ্চিমাংশে এটা এমনকি গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ থেকে ৩০ মিটার উঁচু) সম্ভাব্য মানব বসবাসের অপেক্ষাকৃত অধিকতর আওতাভুক্ত ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃ-ভৌগোলিক নিদর্শনসমূহ বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে এই অনুমানের বৈধতা প্রদান করে। ছোটনাগপুর মালভূমি, রাজমহল পাহাড় এবং হিমালয়-শিলং গিরিশ্রেণীতে প্রবীণ ও নবীন প্রত্নপ্রস্তর যুগে (lower and upper Palaeolithic age) মানব বসতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই স্থানগুলো বাংলার সংলগ্ন। বাংলাদেশের কুমিল্লা, বগুড়া ও জয়পুরহাটে প্লাইসটোসিন যুগের মানব বসতির সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে এই অঞ্চলে কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রাকৃতিক চিত্র এর নদীপ্রণালী বসতির ক্রমবিকাশ ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কৃষিকাযের জন্য উর্বর উপত্যকাসমূহ বরাবর মানব বসতির প্রধান গুচ্ছসমূহ বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন যুগে গাঙ্গেয় সমতলভূমির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী উপত্যকাগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা বসতির নিদর্শন রয়েছে। নদীর উঁচু পাড় বা প্রাকৃতিক বাঁধ (Natural levee) বরাবর নদী উপত্যকাগুলোতে প্রতিনিয়ত মৃত্তিকার নবায়নের ফলে এসকল এলাকা কৃষিকার্যের জন্য সবচেয়ে উর্বর হওয়ায় মানব বসতি নদীর প্রাকৃতিক বাঁধ বা উচু পাড়কে অনুসরণ করেছিল। তদুপরি, অতীতে নদীগুলো ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। গঞ্জ ও তাম্রলিপ্তির মতো কতগুলো বিখ্যাত বাণিজ্যিক ও বন্দর নগরীর অবস্থান ছিল যথাক্রমে গঙ্গা ও ভাগীরথীর তীরে। নদীর গতিপথের হঠাৎ পরিবর্তন এবং নদীর শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বহু বসতি লয়প্রাপ্ত হয়েছে।
ভারতের উত্তরাঞ্চল হতে প্রত্ন-প্রস্তরযুগীয় মানবেরা জায়গা নিয়েছিল বাংলা বদ্বীপ হতে বার্মা, ইন্দো-চায়না, মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে এবং এমনকি অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলেও। প্লাইসটোসিন সময়কালে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা হ্রাস এবং বরফস্তরের দক্ষিণমুখী অপসরণের সঙ্গে সঙ্গে এই স্থানান্তর সংঘটিত হয়েছিল। এই দক্ষিণমুখী সরনের কালব্যাপী বাংলা অববাহিকার উঁচু অঞ্চলে অনেকে বসতি স্থাপন করে থাকতে পারে যেহেতু সমতলভূমির বিল বা জলাপূর্ণ জঙ্গল অপেক্ষা উত্তরের বন আবৃত নিচু পাহাড়কে পরিষ্কার করা সম্ভবত অনেক বেশি সহজ ছিল। কালিমপং এবং চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আন্তঃপ্রত্ন-প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির অনুরূপ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ইঙ্গিত করে যে তিববত ও চীন সংলগ্ন অঞ্চলগুলো হতে কিছু মানুষ এই অংশের মধ্য দিয়ে হয়তো স্থানান্তরিত হয়ে থাকতে পারে।
সুতরাং, সহজপ্রাপ্য নিদর্শনসমূহ সাক্ষ্য দেয় যে, প্লাইসটোসিন সময়কাল জুড়ে বর্তমান বাংলাদেশ গঠনকারী অপেক্ষাকৃত পুরাতন ও কম উঁচু পাহাড়ে প্রত্ন-প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল। এটিও ধারণা করা হয়, যে অল্প কয়েকটি স্থানে প্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল বরেন্দ্রভূমি তার মধ্যে একটি। দক্ষিণাংশ ছিল হয় জলকর্দমপূর্ণ অথবা মোহনাজ পরিবেশের (estaurine) এবং দীর্ঘসময় ধরে মানব বসবাসের জন্য অনুপযোগী গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। প্রাচীন বসতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো ছিল চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল ও লালমাই পাহাড়।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীপ্রণালীর নদীখাত পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে এতদঞ্চলে বসতি সবচেয়ে বেশি অস্থায়ী ছিল। তা সত্ত্বেও মনে করা হয়ে থাকে যে, প্রাচীন সময়ে কৃষি সম্ভাবনা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কারণে বর্তমানের মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চলে (moribund delta) পুরোপুরি আদি এবং পূর্ণাঙ্গ বসতি বিকাশ লাভ করেছিল। তবে দেশের এই অংশে মানব বসতি গড়ে ওঠার প্রকৃত ইতিহাস নির্ণয় করা খুবই কঠিন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের সম্ভাব্য প্রচন্ড আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্ত্তত গঙ্গাহূদি বা গঙ্গাঋদ্ধির যোদ্ধাদের উল্লেখের মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাস গণনা শুরু হয়। এই উল্লেখযোগ্য ঘটনার পূর্বেও সম্ভবত বহু শতাব্দী ধরে বাংলায় সংঘবদ্ধ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন বিরাজমান ছিল। আদি বৈদিক সাহিত্যে প্রথম এই দেশ সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০০০ শতাব্দীতে এই উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিমাংশে আর্যদের অনুপ্রবেশের পূর্বে, বর্তমানের বাংলাদেশ গঠনকারী এলাকাসমূহসহ বঙ্গীয় অববাহিকায় বহুসংখ্যক জনগোষ্ঠী বাস করে আসছিল। আর্যরা গাঙ্গেয় অববাহিকার উজান অঞ্চল দখল করে বসবাস করতে শুরু করে এবং এ অঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে তারা এসেছিল, যাদেরকে তারা নাম দিয়েছিলো ’নিশাদাস’, যার অর্থ বন্য মানুষ। সম্ভবত এরাই ছিল বর্তমানের বাংলাদেশ গঠনকারী অঞ্চলের আদি অধিবাসী। এই অধিবাসীর মধ্যে প্রধান অংশ ছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতিভুক্ত, যারা ‘veddoid’ নামে পরিচিত। এরা ছিল এই উপমহাদেশের দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বা উপদল। কিছু কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল সিনো-তিববতীয় (Sino-Tibetan) ও তিববতীয়-বার্মিজ (Tibeto-Burman)–এর বারিক বিভাগের (Baric Division), যাদের অধিকাংশই বাংলার পার্বত্য অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিলো।
এই অঞ্চলে মানব পরিব্যাপন এবং বসতি বণ্টনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ামক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক অবস্থায় বাংলা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত বসতি সম্বলিত একটি ভূখন্ড। পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চভূমি ও বনভূমি, দক্ষিণের স্রোতজ বনভূমি ও অসংখ্য নদনদীর উপস্থিতি সে অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে গণহারে মানব অভিগমনকে নিরুৎসাহিত করেছে। এমনকি শুষ্কভূমির যাযাবর সংস্কৃতির ধারক আর্যরাও প্রথমদিকে ক্রান্তীয় জলাভূমির এই এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে কম আগ্রহী হয়েছিলো। তদুপরি, উত্তর ও উত্তর-পূর্বের হিমালয় পর্বতমালাও উপমহাদেশের এই অংশে গণঅভিগমনকে বাঁধাগ্রস্ত করেছে।
অসংখ্য নদীমালা এবং ভূমির উচ্চতা দ্বারা বাংলা একাধিক প্রাকৃতিক বিভাজনে বিভক্ত ছিল। এর ফলে, সুপ্রশস্ত দোয়াব (interfluve) অঞ্চল বহু স্বাধীন রাজ্য এবং বসতিকে সুরক্ষা প্রদান করতো। ঐতিহাসিক অতীতে এসকল রাজ্য এবং বসতিগুলো প্রাকৃতিক বাধা ও গভীর বনভূমির উপস্থিতির কারণে দীর্ঘকাল ধরে বিচ্ছিন্ন ছিল।
বঙ্গীয় বদ্বীপের উত্তর এবং দক্ষিণভাগের মধ্যে সীমারেখা ছিল গঙ্গানদী। সে সময় ব্রহ্মপুত্র নদ তার পুরানো গতিপথে, অর্থাৎ বর্তমান গতিপথের পূর্বদিকে প্রবাহিত হতো (আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত) এবং বরেন্দ্রভূমি মধুপুর গড়ের সাথে সংযুক্ত ছিল। করতোয়া ছিল একটি বৃহৎ নদী এবং সরাসরি বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হতো। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে পেরিপ্লাস (Periplus) করতোয়াকে সমুদ্র জাহাজ চলাচল দ্বারা ব্যস্ত একটি বৃহৎ নদী হিসেবে উল্লেখ করেন। পুনর্ভবা এবং করতোয়া নদীদ্বয় বাংলা ও চীনের মধ্যে রেশম ও মসলিন বাণিজ্যের রুট বা পথ হিসেবে ভূমিকা পালন করতো। পরবর্তীকালে গঙ্গার নিম্নপ্রবাহ ও এর শাখা নদীসমূহ দেশের দক্ষিণাংশের বদ্বীপীয় অঞ্চলে মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গঙ্গার প্রধান গতিপ্রবাহ হিসেবে পদ্মার উৎপত্তির সাথে সাথে এই অংশের কৃষি সম্ভাবনা ও যাতায়াত সুবিধা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মানুষ সেখানে বসতি গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তবে, পদ্মা নদী তার বন্যা ও নদীভাঙনের মতো ধ্বংসাত্মক আচরণের জন্যও খ্যাত হওয়ায় বহু বসতি সে তার গর্ভে বিলীন করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, যশোরের অধিকাংশ এলাকা, কুষ্টিয়া এবং খুলনা অঞ্চলের কিছু অংশ প্লাবনসীমার ঊর্ধ্বে অবস্থিত এবং বসতি স্থাপনযোগ্য ছিল। একথাটি সুবিদিত যে, সুন্দরবন স্রোতজ বনভূমি উপরোক্ত অঞ্চলসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং পরবর্তীতে গঙ্গা নদীর বদ্বীপ গঠনক্রিয়া অধিকতর দক্ষিণে বিস্তৃত হওয়ার দরুণ ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি ও মানবীয় কর্মকান্ডের দরুন সুন্দরবন ক্রমশ দক্ষিণমুখী হতে থাকে। আর্যপূর্ব একদল জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে আসছিল যাদেরকে পরবর্তীতে ‘বাগদী’ বলে পরিচয় পাওয়া যায়। উত্তর এবং উত্তরপূর্ব বঙ্গ গভীর বনে আচ্ছাদিত ছিল, তবে এ অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে নিম্ন (lower) আসামের আদিম পাহাড়ী উপজাতীয়দের বসতি ছিল।
বাংলায় মানব বসতির বিস্তৃতি ও বণ্টন ধরন নৌযোগাযোগের সুবিধাবিশিষ্ট নদনদীকে অনুসরণ করতো। নাব্য নদনদীসমূহ একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগাযোগ সুবিধা প্রদান করতো, অন্যদিকে আবার কৃষিকাজের জন্য উর্বর মৃত্তিকারও সংস্থান করতো। বৃহৎ নদনদী ও তাদের উপ-অববাহিকাসমূহ বিভিন্ন জনসমষ্টিকে তথা মানব বসতিসমূহকে পৃথক করে রাখত। প্রাচীনকালে বাংলায় বেশকিছু সংখ্যক জনগোষ্ঠী বসবাস করতো যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি হচ্ছে: ‘পুন্ড্র’, ‘বঙ্গ’ এবং ‘সুহ্ম’। এদের মধ্যে ‘পুন্ড্র’ ও ‘বঙ্গ’ বাংলায় বসতি স্থাপনকারী আদি জনগোষ্ঠীদের মধ্যে পূর্বতন জনগোষ্ঠীদ্বয়। পুন্ড্র ও বঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগবৈদিক যুগ পরবর্তী সাহিত্যে, যেখানে কোন দেশের কথা না বলে সুস্পষ্টভাবে এই দুই জনবসতিকে দুটি পৃথক বসতি একক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসমূহকেও এসকল নামেই নামকরণ করা হয়েছে। যার ফলে, বঙ্গ নামের অঞ্চলটির নামকরণের উৎপত্তি হয়েছে ভঙ্গ বা বঙ্গ উপজাতীয়দের নাম থেকে।
তদুপরি, কোন এলাকায় বিভিন্ন রাজকীয় পরিবারের কর্তৃত্ব এবং পেশীশক্তির প্রভাবের মাত্রার উপর বসতি চক্রাকারে গড়ে ওঠার প্রমাণ রয়েছে। অথবা কোন এলাকায় ধর্মীয় প্রাধান্য কিংবা চাষাবাদ ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের গুরুত্বের কারণেও বসতি গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ধর্মীয় অথবা অর্থনৈতিক প্রাধান্য হ্রাস এবং বিরূপ প্রাকৃতিক অবস্থার (যেমন: প্রবল বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ) ফলে বসতি ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত অথবা বিরানে পরিণত হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত সমগ্র ভারতে ১৬টি মহাজনপদ (বৃহদাকার বসতি) বিদ্যমান ছিল। এদের মধ্যে বঙ্গ এবং পুন্ড্রবর্ধন (অঙ্গ, কলিঙ্গ এবং সুহ্মসহ) - এই দুটি মহাজনপদের অবস্থান ছিল বাংলা অঞ্চলে। সম্রাট অশোকের শাসনামলে (২৭৩-২৩২ খ্রি. পূর্ব) ও পরবর্তী হিন্দু যুগসমূহে পুন্ড্র (কোশী এবং করতোয়া নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল) ও বঙ্গ (দক্ষিণ ও মধ্য বাংলা) এবং গুপ্ত শাসনামলে (২৪০-৫৭০ খ্রিস্টাব্দ) দক্ষিণমধ্য ও পূর্ব বাংলা নিয়ে গঠিত সমতট অঞ্চল প্রভৃতি সমৃদ্ধ বসতি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। খ্রিস্ট পরবর্তী চতুর্থ শতকের মধ্যে বাংলাদেশের সমভূমিতে অবস্থিত অধিকাংশ বনজঙ্গল পরিষ্কার করা হয়ে যায় এবং পঞ্চম হতে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে সুন্দরবন, খুলনা ও বাকেরগঞ্জের উর্বর নিম্নভূমিতে বসতি সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু নদীখাতসমূহের স্থানান্তর এবং মহামারীর কারণে খ্রিস্ট পরবর্তী দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে এসকল বসতি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়কালে এ অঞ্চলগুলোতে পুনরায় বসতি গড়ে ওঠে। অনেক শাসক, বিশেষ করে সম্রাট আকবর, কৃষিজমি সম্প্রসারণ এবং পতিত জমিতে বসতি গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সম্রাট আকবরের শাসনামলে যশোরের কিছু অংশ, নোয়াখালী এবং ফরিদপুর গভীর বনভূমিতে আচ্ছাদিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম শাসকগণ এসকল এলাকায় কৃষিকার্যের পত্তন ঘটাতে শুরু করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে প্রতাপাদিত্য সুন্দরবন অঞ্চল এবং যশোর এলাকায় তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। সুন্দরবন অঞ্চলে অসংখ্য প্রাচীন বসতির ধ্বংসাবশেষ সে এলাকায় বর্ণিত সময়কালে মানব দখলদারিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে।
এভাবে কৃষির সম্প্রসারণ ও নতুন ভূমির বিস্তৃতির ফলে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার উর্বর প্লাবনভূমিতে নতুন নতুন বসতি গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এসকল এলাকায় বসতি ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠে এবং ঢাকা ও সোনারগাঁও সমগ্র অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসনের শুরুর দিকে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ এলাকা বসতির আওতাভুক্ত ছিল এবং অবশিষ্ট এলাকা বন ও জলাভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। উপনিবেশিক শক্তির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ আন্তঃআঞ্চলিক জনসংখ্যা স্থানান্তর এবং বসতি সম্প্রসারণে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।
দুর্ভিক্ষ, মহামারী অথবা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নদী উপত্যকা অথবা সমভূমি এলাকার সনাতন বসতিগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে আবার সেসকল এলাকায় প্রথম পুনর্বাসন সংঘটিত হয়েছিল। এভাবে ১৮৭০ সালের মধ্যে বাংলার অধিকাংশ এলাকা মানব বসতি ও কৃষির আওতায় চলে আসে। [সাবিহা সুলতানা]
গ্রন্থপঞ্জি Rc Dutt, The Economic History of India under Early British Rule, Paul, Trench, and Trubner, London, 1906; Hc Roychoudhury, ‘Physical and Historical Geography’ in RC Majumdar ed, 1963; A Bakar, ‘Human Settlement in the Bengal Basin in relation to Geological Setting’ in Journal of the Asiatic Society of Pakistan, 16(1), 1971.