বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর জেলার সালনায় অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে (১৯৯৮ সালের ১৬ নং আইন) প্রাক্তন Institute of Postgraduate Studies in Agriculture (IPSA) পুনর্গঠন করে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার প্রসার এবং কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ে উন্নত শিক্ষাদান, গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তরের লক্ষ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৮ সাল থেকেই।
কৃষিতে উচ্চ শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে Bangladesh College of Agricultural Sciences (BCAS) প্রতিষ্ঠা করে। জাপান সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় শীঘ্রই এ কলেজের সন্তোষজনক ভৌত, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কৃষিবিজ্ঞানে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন মেটাতে সরকার ১৯৮৩ সালে কলেজটিকে স্নাতকোত্তর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান IPSA-তে রূপান্তরিত করে এবং কৃষিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৪ সাল থেকে IPSA-তে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনুসরণ শুরু হয়।
প্রথম থেকেই BCAS এবং IPSA বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক আওতায় ছিল। ১৯৮৮ সাল থেকে IPSA কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং একটি ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় এর কর্মকান্ড পরিচালনা করতে শুরু করে। IPSA-র প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন একজন রেক্টর (Rector)। ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতির এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে IPSA একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়।
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান; ফলিত কৃষি গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য জোগানো; উন্নত ফসলের জাত, লাগসই প্রযুক্তি এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন ও প্রসার ঘটানো; উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় অন্যান্য শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং কৃষি সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
বিভাগসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কৃষিতত্ত্ব, ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান, কীটতত্ত্ব, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন, উদ্যানতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ এবং কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন নামে দশটি বিভাগ চালু রয়েছে। এছাড়া পরিসংখ্যান নামে একটি সহযোগী বিভাগ রয়েছে, যা পরিসংখ্যান ও উপাত্ত বিশ্লেষণ বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক কোর্স প্রদান করে থাকে এবং শিক্ষক ও গবেষকদের উপাত্ত বিশ্লেষণে সহযোগিতা করে।
শিক্ষা কার্যক্রম এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি শিক্ষা বর্ষকে অটাম (Autumn), উইন্টার (Winter) এবং সামার (Summer) এই তিনটি টার্ম-এ (Term) ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি টার্মের কার্যকাল ১২ সপ্তাহ। ২০০১ সালের প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস কোর্সে ১৯২ জন এবং পিএইচ.ডি কোর্সে ২৭ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত ছিলেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৯ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীসহ মোট প্রায় ৫০ জন আনুষঙ্গিক অধ্যাপক (Adjunct Faculty) রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকান্ডে সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা ও ১৪৪ জন কর্মচারী কার্যরত আছেন।
গবেষণা কার্যক্রম স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রতিটি ছাত্রকে থিসিস-এর জন্য গবেষণা কাজ সম্পন্ন করতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিটি বিভাগেরই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা কর্মসূচি রয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ এসব গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত।
ভৌত সুবিধাদি শিক্ষা, গবেষণা ও সহায়ক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য প্রায় ৭৬ হেক্টর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে রয়েছে অনুষদ ভবন, অডিও ভিজুয়াল (audio-visual) সুবিধাসহ শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, মাঠ গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডরমিটরি ইত্যাদি। অন্যান্য ভৌত স্থাপনার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন, মসজিদ, ব্যাংক, ডাকঘর ইত্যাদি।
মাঠপর্যায়ে গবেষণার জন্য ১৬ হেক্টর জমিসহ একটি আধুনিক মানের গবেষণাগার রয়েছে। খামারে চাষাবাদের জন্য রয়েছে ট্রাকটর, পাওয়ার টিলার, সেচের সুবিধাদি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। তাছাড়া ফসল আহরণ, মাড়াই ও শুকাবার জন্য সব ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রোন মাইক্রোসকোপ গবেষণাগার অতি আধুনিক মানের। ট্রান্সমিশন ও স্ক্যানিং-এর সুবিধাসহ ফটোপ্রসেসিং-এর জন্য এ গবেষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে একটি ফটোগ্রাফিক কক্ষ।
আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, যেমন বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা, মৃত্তিকার তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, দিনের দৈর্ঘ্য, বাতাসের চাপ ও গতিবেগ ইত্যাদি পরিমাপের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সজ্জিত একটি আবহাওয়া কেন্দ্র আছে। এছাড়া উপাত্ত বিশ্লেষণ (data analysis), ওয়ার্ড প্রসেসিং এবং গ্রাফিকস্-এর (graphics) সুবিধাসহ একটি কম্পিউটার সেন্টার গবেষক ও ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত। এ কম্পিউটার সেন্টারে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
অন্যান্য কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত গবেষণালব্ধ ফলাফল কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে পৌঁছনোর জন্য নিয়মিতভাবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এছাড়া গ্রাম পর্যায়ে কৃষি ও কৃষকদের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তা সমাধানের জন্য গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৯১ সাল থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় Annals of Bangladesh Agriculture নামে একটি ষাণ্মাসিক গবেষণা জার্নাল নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে।
গ্রন্থাগার এখানে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রায় ১২ হাজার বই ও দেশী-বিদেশী ২২৭টি জার্নাল। ছাত্র-শিক্ষকদের সুবিধার জন্য CD-ROM এবং ইন্টারনেট-এর ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশাসন ভাইস-চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ভাইস-চ্যান্সেলরকে সহায়তা দান করে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট। [এস.এম হুমায়ুন কবির]