ধোয়ী
ধোয়ী (১২শ শতক) সংস্কৃত কবি ও লক্ষ্মণসেনের (১১১৯?-১২০৫?) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অপর চারজন হলেন জয়দেব, শরণ, উমাপতিধর ও গোবর্ধন আচার্য। ধোয়ী নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে বিভিন্ন জন ব্রাহ্মণ, বৈদ্য এবং তন্তুবায় সম্প্রদায়ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এ যাবৎ তাঁর একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সেটি হলো পবনদূত। কাব্যটি বাঙালি কবিদের রচিত সংস্কৃত দূতকাব্যসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম। মন্দাক্রান্তা ছন্দে ১০৪টি শ্লোকে রচিত এ কাব্যের শেষভাগের একটি শ্লোকে (১০১) গৌড়েন্দ্র লক্ষ্মণসেনকে কবি তাঁর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কাব্যটিতে লক্ষ্মণসেন এবং গৌড়সহ ভারতের অন্যান্য কতিপয় স্থান ও নদনদীর বর্ণনা আছে। লক্ষ্মণসেন দিগ্বিজয় উপলক্ষে দক্ষিণদেশে গেলে কুবলয়বতী নাম্নী এক গন্ধর্বকন্যা তাঁর প্রেমাসক্ত হয় এবং সে পবন অর্থাৎ বায়ুকে দূত করে তাঁর নিকট প্রেরণ করে। এটাই কাব্যের মূল বিষয়বস্ত্ত।
কাব্যটিতে গৌড়দেশের রাজধানীর চমৎকার বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তখন বাংলায় সুপারি গাছের প্রাচুর্য ছিল (শ্লোক ৩৮)। আরও জানা যায় যে, দিগ্বিজয়কালে লক্ষ্মণসেন দক্ষিণদেশীয় রাজাদের পরাজিত করেন এবং তাঁর সময়ে বিজয়পুর ছিল গৌড়ের রাজধানী। এছাড়া তৎকালীন ভারতের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের কিছু ভৌগোলিক তথ্যও এ কাব্য থেকে পাওয়া যায়। পবনের গতিপথের বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি পান্ড্যদেশ, উরগপুর, সেতুবন্ধ, কাঞ্চীপুর, চোল, কেরল, অন্ধ্র, কলিঙ্গ, সুহ্ম প্রভৃতি স্থান; তাম্রপর্ণী, সুবলা, কাবেরী, গোদাবরী, রেবা, নর্মদা, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি নদী এবং ভিল ও শবরজাতির নাম উল্লেখ করেছেন।
কাব্যটি রচনায় কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের প্রভাব আছে, তবে মেঘদূতের মতো এতে পর্ববিভাগ নেই। এর ভাষা প্রাঞ্জল ও সরস। ধোয়ীর কবিপ্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ জয়দেব তাঁকে ‘কবিক্ষ্মাপতি’ (কবিদের রাজা) এবং ‘শ্রুতিধর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে দূতকাব্য রচনার দৃষ্টান্ত বিরল। এ হিসেবে পবনদূত সংস্কৃত দূতকাব্যের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। পবনদূত ব্যতীত সদুক্তিকর্ণামৃত, সুভাষিতমুক্তাবলী, শার্ঙ্গধরপদ্ধতি প্রভৃতি কোষকাব্যে ধোয়ী রচিত অনেক প্রকীর্ণ কবিতা পাওয়া যায়। [কানাইলাল রায়]