দাশ, জীবনানন্দ
দাশ', 'জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) কবি, শিক্ষাবিদ। তিনি ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও সমাজসেবক। তিনি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন কবি।
জীবনানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৫), বিএম কলেজ থেকে আইএ (১৯১৭) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ (১৯১৯) ও ইংরেজিতে এমএ (১৯২১) পাস করেন। আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষা দেননি।
জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দেন, কিন্তু কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই (১৯২৯) তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৩০-এ আবার দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে কিছুকাল বেকার থেকে জীবনানন্দ ১৯৩৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজে যোগদান করেন। এভাবে তাঁর কর্মজীবন বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনায় এবং মাঝে মাঝে অন্য পেশায় অতিবাহিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি সপরিবারে কলকাতা চলে যান।
জীবনানন্দ ছিলেন বাংলা কাব্যান্দোলনে রবীন্দ্রবিরোধী তিরিশের কবিতা নামে খ্যাত কাব্যধারার অন্যতম কবি। পাশ্চাত্যের মডার্নিজম ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গীয় সমাজের বিদগ্ধ মধ্যবিত্তের মনন ও চৈতন্যের সমন্বয় ঘটে ওই কাব্যান্দোলনে। #চিত্র:দাশ, জীবনানন্দ html 88407781.png
- জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু অল্পবয়স থেকেই। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩২৬/এপ্রিল ১৯১৯) প্রকাশিত হয়। মূলত কবি হলেও তিনি অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত অসংখ্য পান্ডুলিপিতে। ল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান, সুতীর্থ, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, বাসমতীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুশতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫) নামে তাঁর একটি মননশীল ও নন্দনভাবনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ আছে। সম্প্রতি
কলকাতা থেকে তাঁর গদ্যরচনা ও অপ্রকাশিত কবিতার সংকলনরূপে জীবনানন্দ সমগ্র (১৯৮৫-৯৬) নামে বারো খন্ড রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্যধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তাঁর কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। বিশেষত, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসূক্ষ্ম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্পজগতে মূর্ত হয়েছে বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগরজীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয়বোধ।
জীবনানন্দ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসচেতন কবি। তিনি ইতিহাসচেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচেচ্ছদ্য সম্পর্কসূত্রে বেঁধেছেন। তাঁর কবিস্বভাব ছিল অন্তর্মুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরাচেতনার শব্দরূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। এ সূত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দ্রিয়বিপর্যাস (synaesthesia) ও রঙের অত্যাশ্চর্য টেকনিক। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দনিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর অনন্যতা বিস্ময়কর। বিশেষত, কবিতায় উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযু্ক্ত করেন, যা পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে।
জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্যজীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌনসম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তাঁর প্রায় গল্প-উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনানন্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংগ্রামী বাঙালি জনতাকে তাঁর রূপসী বাংলা তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে।
জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। এছাড়া জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিও ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৪) লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [বেগম আকতার কামাল]