দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ১৯৮৫ সালে গঠিত একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট। শুরুতে এই জোট দক্ষিণ এশীয় সাতটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে গঠিত হয়। ২০০৭ সালে ১৪ তম শীর্ষ সার্কসম্মেলনে আফগানিস্তানকে সার্কের সদস্য করা হয়। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আয়তন, ভৌগোলিক প্রকৃতি, জনসংখ্যা, জাতি, ধর্ম ও সম্পদের দিক থেকে ব্যাপক বৈচিত্র্য বিদ্যমান। বস্ত্তত সার্কের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্রসমূহ অসম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত। সার্ক ভুক্ত রাষ্ট্র ভারত সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ কম শক্তিধর ছোট রাষ্ট্র। এ কারণে এ সকল রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদ বিভাজনেও সমতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৫% লোকই বাস করে ভারতে, ৯.৫% পাকিস্তানে, ৯% বাংলাদেশে, এবং অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী সার্কের বাকী ৫ টি রাষ্ট্রে বসবাস করে। সার্ক অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের অন্যতম।
অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ হলো আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট গঠন করা। যথার্থ অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সহযোগিতা ও সমঝোতা। সুদীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান বিদ্বেষ এবং আস্থার অভাব দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে ধীরগতি সম্পন্ন করে তুলেছে।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট গঠনের ধারণা দেন। অবশেষে ১৯৮৫ সালে ঢাকা শীর্ষসম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠিত হয়। এই সম্মেলনে ঢাকা ঘোষণার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট ম্যানিফেস্টেশনের মাধ্যমে সার্ক নেতৃবৃন্দ আঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্যে এবং নিজেদের মধ্যে সাদৃশ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব আস্থা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়।
সার্ক সনদের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সার্কভূক্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানদের ‘বছরে একবার বা সদস্য রাষ্ট্রসমূহ প্রয়োজন মনে করলে যেকোন সময়ে সার্ক বৈঠকের আয়োজন করতে পারে’। যদিও এ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর সার্কের বাৎসরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নি। প্রকৃতপক্ষে বিগত ২৫ বছরে ১৯৮৫-২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে সার্কের ১৬ টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৫ সালের ঢাকা শীর্ষসম্মেলনে ঘোষিত সার্ক সনদের আটটি উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে: ১. দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন; ২. এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, সামাজিক অগ্রগতি সাধন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং প্রতিটি দেশের স্ব স্ব মর্যাদা সমুন্নত রেখে সহাবস্থানের সকল প্রকার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করা; ৩. সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সমষ্টিগত আত্মনির্ভরশীলতা জোরদার করা; ৪. পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপন, সমঝোতা এবং অন্যের সমস্যা উপলব্ধি করা; ৫. অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা বৃদ্ধি; ৬. অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সহযোগিতার প্রসার ঘটানো;৭. সর্বজনীন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা; ৮. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা।
সার্ক প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এর লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কাঠমন্ডুতে সার্কের স্থায়ী সচিবালয় স্থাপিত হয়। ১৯৮৭ সালে তৃতীয় সার্ক শীর্ষসম্মেলনের মাধ্যমে কাঠমন্ডু ঘোষণা জারি করা হয় এবং এ ঘোষণায়ও সার্কভুক্ত অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা, অখন্ডতা ও অগ্রগতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সার্ক শীর্ষসম্মেলনের ঘোষণায় সার্কের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় এবং জনসংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে, সার্ক-এর সভাপতিত্ব, ফেলোশীপ ও স্কলারশীপ স্কিম, সার্ক ভলান্টিয়ার বিনিময় কর্মসূচি এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে ভিসা বিলোপ স্কিম। পঞ্চম সার্ক শীর্ষসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে মালেতে এবং এতে সার্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৩ নভেম্বর মালে ঘোষণা জারি করা হয়। এ সম্মেলন দ্বারা সার্কের কর্মকান্ডে গতি সঞ্চারে সহায়ক হয়। চতুর্থ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্যে সার্কের আঞ্চলিক কনভেনশন গৃহীত হয়, যা পরবর্তী মালে সম্মেলনে পুনরায় জোরালো ভাবে আলোচিত হয়। সার্ক নেতৃবৃন্দ প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বজনীন সমস্যা সন্ত্রাসবাদের দমনের লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্যে পৌছায়। এছাড়াও মাদক পাচার, মানব পাচার বিশেষ করে নারী ও শিশু পাচারের মতো বিষয়গুলো দূর করার ক্ষেত্রে সার্ক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ঘোষণার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সার্ক দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করার প্রচেষ্টা চালায়। সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মকান্ডের সমন্বয় এবং তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটিকে সহায়তা করার জন্য চারটি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এসব কেন্দ্র হচ্ছে সার্ক কৃষি তথ্যকেন্দ্র, সার্ক আঞ্চলিক আবহাওয়া কেন্দ্র, সার্ক ডকুমেন্টেশন কেন্দ্র এবং সার্ক যক্ষ্মা কেন্দ্র।
সার্কের প্রাথমিক সনদে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয় নি। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সার্ক শীর্ষসম্মেলনে সদস্য দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ অবাধ বাণিজ্য সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। এর লক্ষ্য ছিল, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব ভোগের নিশ্চয়তা বিধান। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ এশীয় অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (SAPTA) স্বাক্ষরিত হয়। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটাই প্রথম বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ। সাপটা গঠনের লক্ষ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের ভিত্তিতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উন্নয়ন ও তার স্থায়িত্ব বজায় রাখা। সাপটার আওতায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ধাপে ধাপে বাণিজ্যিক শুল্ক হ্রাসের বিষয় নির্ধারিত হয়। শুল্কযুক্ত ও শুল্কবিহীন পণ্যসামগ্রী নির্ধারণে বিরাজমান বাধাগুলো পর্যায়ক্রমে দূর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আশা ব্যক্ত করা হয় যে, সাপটার মাধ্যমে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে, যা পরিণামে উৎপাদন ও রপ্তানি বাণিজ্যে সাধারণ মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং তা এ অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে। এ সময়ের মধ্যে চারটি পর্যায়ের গোলটেবিল আলোচনায় ৫০০ পণ্যদ্রব্য অন্তর্ভূক্ত হয়। প্রতি পর্যায়ের আলোচনায় দ্রব্যের অন্তর্ভূক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায় এবং সেই সাথে পূর্বের বছরের তুলনায় শুল্ক হ্রাস করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই এদের মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিরূপণ করা প্রয়োজন। অতীতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল শিল্পোন্নত ও শিল্পে অনুন্নত এবং সার্ক-এর সদস্য নয় এমন দেশের সঙ্গে। সাতটি দেশের প্রতিটিই এসব দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এ অঞ্চলের বাণিজ্যের শতকরা মাত্র তিন ভাগ আন্তঃআঞ্চলিক। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের স্বল্পমাত্রার অন্যতম কারণ সার্কভুক্ত দেশগুলোর পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক প্রয়োগের অসমতা। দূর্বল রাষ্ট্র সমূহের জন্য উপযুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার নেই। ছোট রাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশের বাজারে ভারতের যে পরিমাণ রপ্তানি সে তুলনায় বাংলাদেশ ভারতের বাজারে স্বল্প পরিমাণে রপ্তানি করতে পারে। এমনকি ১৭ বছর অতিক্রান্তের পরও সাপটা চুক্তি ভারত বাংলাদেশের বহুল পরিমাণের এই বাণিজ্য অসমতা দূর করতে পারে নি। তবে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় সার্ক দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) সূচনা করে ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত এর ১২ তম শীর্ষসম্মেলনে। সাফটা চুক্তির দ্বারা ২০১৬ সালের শেষনাগাদ এ অঞ্চলে পণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শূণ্য শতাংশ হারে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শর্ত আরোপ করা হয়। এই লক্ষ্যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকাকে ২০০৯ সালের মধ্যে ২০% এবং ২০১২ সালের মধ্যে শূণ্য শতাংশে শুল্ক কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। সাফটা স্বল্পোন্নত (এলডিসি) রাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশ, ভূটান, মালদ্বীপ এবং নেপালের মতো রাষ্টের জন্য বিশেষ ছাড়ের অনুমোদন দেয় (সে সময়ে আফগানিস্তান সার্কের অন্তর্ভূক্ত ছিল না)। স্বল্পোন্নত এই রাষ্ট্রগুলো তাদের শুল্ক শূণ্য শতাংশে নামিয়ে আনতে চার বছর অতিরিক্ত সময় পায়।
সার্ক সনদে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা উপআঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় নি। শ্রীলঙ্কা ও ভারত উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। অনুরূপভাবে, বাংলাদেশ ও ভারত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১০ সালে পুনরায় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে, যে চুক্তির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মালামাল আদান প্রদানের লক্ষ্যে ভারতকে অন্য কিছু সুবিধার সাথে ট্রানজিট সুবিধাও দেয়া হয়। এ ছাড়াও ভারত ও নেপাল এবং ভারত ও ভুটানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সার্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বহুপক্ষীয় চুক্তির চাইতে বেশি সুফল নিয়ে আসে।
সার্ক নেতৃবৃন্দ বেসরকারি পর্যায়ে সার্কের মূল প্রেরণাকে সক্রিয় রাখার গুরুত্ব স্বীকার করেন। উচ্চ পর্যায়ের সফল বৈঠকগুলোর আলোচনায় এটা স্বীকৃত যে, সার্কের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদ, বেসরকারি সংস্থা এবং পেশাজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এর সচিবালয় করাচিতে অবস্থিত। এই চেম্বার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করে। এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউশন্স ইন সাউথ এশিয়া’ (AMDISA) সার্কভুক্ত দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সার্কের প্রেরণা জোরদার করার লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এছাড়া সার্ক সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যে আগ্রহের সূচনা করতে সক্ষম হয়েছে। সার্ক এর কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে সার্কভূক্ত দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিনিময়ের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। একইভাবে বিভিন্ন প্রফেশনালদের নিয়ে অনেকগুলো সার্ক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নবম সার্ক শীর্ষসম্মেলনে ‘দি সার্ক গ্রুপ অব এমিনেন্ট পার্সনস’ নামে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে সার্কের ভূমিকা আরও সক্রিয় করার লক্ষ্যে যথাযথ সুপারিশ পেশ করার অনুরোধ জানানো হয়। সার্কের ১৩ তম এবং ১৪ তম শীর্ষসম্মেলনে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে যার প্রধান ক্যাম্পাস স্থাপন করা হয় দিল্লিতে এবং প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রে পৃথক ক্যাম্পাস স্থাপন করা হয়। সার্কের বাস্তব অর্জনের মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
সার্কের ১৫ তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের আগস্টে। এই সম্মেলনে সার্ক নেতৃবৃন্দ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য সম্মিলিতভাবে আঞ্চলিক প্রচেষ্টার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনরায় ঘোষণা করে যা দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণে এবং জীবনধারার উন্নয়নে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে এ অঞ্চলের শান্তি, স্থায়িত্ব, সৌহার্দ্য এবং অগ্রগতিতে অবদান রাখবে।
২০১০ সালের এপ্রিলে ভূটানে অনুষ্ঠিত সার্কের ১৬ তম রজত-জয়ন্তী সম্মেলনে অনেক আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সাধিত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রের লক্ষ্যে একটি সার্ক চার্টার গ্রহণে মত প্রকাশ করে, যার দ্বারা নেতৃবৃন্দের মতে সার্ক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে, সরকারের এবং সমাজের সকল স্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়াও এ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবেলায় একটি ফান্ড গঠনে একমত হন এবং হিমালয় কাউন্সিল গঠনে বাংলাদেশের প্রস্তাব সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়।
নানাবিধ কারণে সার্ক তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে পারে নি। এর কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন যে, বাস্তব কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণের চাইতে সার্কের মধ্যে আলোচনাই বেশি হয়ে থাকে। সার্কের ১১ তম সম্মেলন পর্যন্ত সার্কের প্রধান কার্যক্রম ছিল সেমিনার, কর্মশালা এবং স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর আয়োজন করা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং ক্রীড়ানুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। সাপটা আলোচনার ক্ষেত্রে চার পর্যায়ের আলোচনা বাণিজ্য উদারীকরণের ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও সার্ক এখনও পর্যন্ত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট হিসেবে পরিণতি লাভ করতে পারে নি। এ অঞ্চলের আন্তঃ-আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ জোট ইপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে নি। এক কথায় বলা যায়, আসিয়ান এবং নাফটার মতো আঞ্চলিক সংস্থার সাফল্যের তুলনায় সার্কের সাফল্য অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর বাধার কারণে সার্কের মাধ্যমে বহুপক্ষীয় যে সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা ছিল তা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না এবং এই জোট উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। মনে হয় সার্কের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও সময়ের প্রয়োজন। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী মনোভাবের সমাপ্তির মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সুদৃঢ় করার ওপর নির্ভর করছে সার্কের অগ্রগতি। [হাফিজ জি.এ সিদ্দিকী]