সরকার, দীনেশচন্দ্র
সরকার, দীনেশচন্দ্র (১৯০৭-১৯৮৫) ইতিহাসবেত্তা, লিপি-বিশারদ এবং ভারতীয় প্রাচীন লিপি বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৯০৭ সালের ৮ জুন ফরিদপুরের নিকটবর্তী কৃষ্ণনগরে এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৯ সালে সংস্কৃত বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং লিপি ও মুদ্রাতত্ত্বে বিশেষ দক্ষতাসহ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ১৯৩১ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৭ সালে ড. ভান্ডরকরের তত্ত্বাবধানে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ ছাত্র হিসেবে সফল গবেষণা কাজের জন্য তাঁকে মৌয়াত স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের লেকচারার হিসেবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন (১৯৩৭-৪৯)। অতঃপর তিনি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের লিপি শাখায় কর্তব্যরত ছিলেন এবং অবশেষে তিনি সরকারি লিপিবিশেষজ্ঞ হন। ১৯৬২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের কারমাইকেল অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৩৯ সালে The Successors of the Satvahanas in the Lower Deccan নামে তাঁর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন এবং ১৯৮৪ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সময়ে তিনি কমপক্ষে ৪০টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, প্রায় বারো শত গবেষণামূলক প্রবন্ধ, টীকা ও সমালোচনা লেখেন এবং ২২টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। প্রাচীন ভারতীয় শিলালিপি, বিশেষত ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীন ভারতীয় শিলালিপিগুলির সম্পাদনা ও তার পাঠোদ্ধারে তাঁর জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তাঁর এ গভীর জ্ঞানের প্রমাণ পাওয়া যায় এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকায় প্রকাশিত তাঁর ২০৭টি প্রবন্ধে। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা ছিল ভারতীয় শিলালিপির উপর বিশেষ পত্রিকা। ভারতের সরকারি লিপি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীনেশচন্দ্র সরকার এটি সম্পাদনা করেছিলেন।
সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় তাঁর দক্ষতা এবং প্রাচীন হস্তলিপিতে তাঁর কিংবদন্তিতুল্য ব্যুৎপত্তির ফলেই তিনি ভগ্ন ও অবহেলিতভাবে সংরক্ষিত লিপিসমূহের যথার্থ সম্পাদনা করতে সমর্থ হন। প্রাচীন ভারতের লিখিত প্রমাণাদির মধ্যে শিলালিপিকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ছাত্ররা দীনেশচন্দ্র সরকারের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। কারণ, শিলালিপি বিশ্লেষণে তার বিরাট অবদানের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। মূল উপাদানের ভিত্তিতে তার গবেষণাকর্ম বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রামাণিকতা এবং যথার্থতার পরিচয় বহন করত। তাঁর প্রধান প্রকাশনাগুলির মধ্যে Select Inscriptions Bearing on Indian History and civilization (দুই খন্ডে), Indian Epigraphs, Indian Epigraphical Glossary, Asokan Studies, Epigraphical Discoveries in East Pakistan ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। পৌরাণিক উৎস সম্পর্কে তাঁর বিশদ জ্ঞানের পরিচয়ও পাওয়া যায় তার রচিত Studies in the Yugapurana and other Texts, Mahamayuari, Lists of Yaksas, Studies in the Political and Administrative Systems of Ancient and Medieval India, Studies in the Religious Life of Ancient and Medieval India ইত্যাদি গ্রন্থগুলিতে।
প্রধানত রাজবংশীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে লিপি সংক্রান্ত উপাদানসমূহের নিরপেক্ষ ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত লাভ করলেও দীনেশচন্দ্র সরকার ওই সকল শিলালিপির যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্যাদিতে পূর্ণ ছিল, একজন প্রথম ব্যাখ্যা প্রদানকারীও ছিলেন। তিনি আরও স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন যে, লিপি সংক্রান্ত এসব তথ্য আদর্শ ধর্মশাস্ত্র সাহিত্যে বিধৃত আদর্শ আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতেও পারে, আবার নাও পারে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ তাঁর Problems of early Indian Social History এবং ‘Aspects of Early Indian Economic Life’ (Indian Museum Bulletin, XIV, 1919-এ প্রকাশিত)।
তাঁর অবদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল প্রাণবন্ত বিতর্ক যা তিনি ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের আদর্শের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন এবং বাতিলকরণ বিষয়টি তুলেছিলেন। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের ধারণার বিপক্ষে তিনি লেখেন Landlordism and Tanancy in Ancient and Medieval India as Revealed by Epigraphical Records এবং Emperor and His Subordinate Rulers.
অধিকাংশ রচনাসমূহ ইংরেজিতে হলেও সরকার বাংলা ভাষাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন। এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর শিলালেখ তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ, পাল পূর্ব যুগের বংশানুচরিত, পাল সেন যুগের বংশানুচরিত এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ লেখনীতে।
বিস্ময়কর পান্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানিত করেছে। ইন্ডিয়ান হিস্টরি কংগ্রেস (বোম্বে অধিবেশন, ১৯৮০) তাঁকে সাধারণ সভাপতি নির্বাচিত করে এবং তিনি ছিলেন Sir William Jones Memorial Plaque-এর গ্রহীতা (এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৭২)। ১৯৮৫ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। [রণবীর চক্রবর্তী]