লাক্ষা
লাক্ষা প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য। কিন্তু ঊনিশ শতকের মধ্যভাগের পর এর চাহিদা লোপ পায়। বিদেশিদের কাছে লাক্ষা সাধারণভাবে ‘বেঙ্গল লাক্ষা’ নামে পরিচিত ছিল। শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিক যুগে ইংল্যান্ডে লাক্ষাকে মূল্যবান দ্রব্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বস্ত্র রং করার জন্য ও অন্যান্য শিল্প দ্রব্যের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো এই লাক্ষা। সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলির রপ্তানি বাণিজ্যের বহরে এটি অন্যতম মূল্যবান দ্রব্য ছিল।
লাক্ষা পোকা পালনে উপযোগী বিভিন্ন ধরনের গাছে লাক্ষা উৎপাদন করা হতো। লাক্ষা চাষি বিশেষ গাছের নির্বাচিত ডালপালায় লাক্ষা পোকা পালন করত। এক সময় এই ডালগুলি পোকার মুখনিঃসৃত রসে সংক্রমিত হয়ে পোকার গুণগত ভিন্নতার কারণে কখনও লাল, গোলাপী অথবা রক্তবর্ণ ধারণ করত। উপযুক্ত সময়ে সংক্রমিত ডালগুলি কেটে প্রথমে ভেজানো হতো এবং পরে তা পানিতে সিদ্ধ করা হতো। যতক্ষণ পর্যন্ত ডালগুলি থেকে রং বেরুত ততক্ষণ পর্যন্ত সিদ্ধ করা অব্যাহত থাকত। লাক্ষার এই নির্যাসে প্রয়োগ করা হতো সামান্য পরিমাণ ফিটকিরি। এবার নির্যাসকে বাষ্পে পরিণত করা হতো। নিচে পড়ে থাকা রঙ্গের গুঁড়াকে একত্রিত করে বিভিন্ন খন্ডে খন্ডে সংরক্ষণ করতে হতো। লাক্ষা চাষের জন্য বস্ত্রবয়ন শিল্পিদের মতোই বিদেশিরা লাক্ষাচাষিদের নিয়োগ করত। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে সংশ্লেষী বা সিন্থেটিক রং আবিষ্কৃত হলে লাক্ষা তার বিশ্ব বাজার হারিয়ে ফেলে। তবে বিশ শতকের প্রথমাবধি এর স্থানীয় ব্যবহার অব্যাহত ছিল। বাংলা ছাড়াও লাক্ষা বার্মা ও দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত হতো। কিন্তু বিদেশি ক্রেতাদের নিকট বাংলার লাক্ষার চাহিদা ছিল সর্বাধিক। লাক্ষা দুই ভাবেই রপ্তানি হতো। কখনও সংক্রমিত ডাল চটের ব্যাগে পুরে আবার কখনও রঙের টুকরো হিসেবে। [সিরাজুল ইসলাম]