তাবলীগ
তাবলীগ আরবি শব্দ ‘তাবলীগ’-এর অর্থ পৌঁছে দেওয়া, জ্ঞাত করানো বা প্রচার করা। অতএব ইসলামের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াকেই বলে তাবলীগ। নিজে সৎকর্ম করা ও অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং অন্যকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করাই তাবলীগের উদ্দেশ্য। এ তাবলীগের জন্য বিভিন্ন সময়ে আল্লাহু তা‘আলা নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদের অনুসারীদের দায়িত্ব হচ্ছে তাবলীগের কাজ চালিয়ে যাওয়া।
মাওলানা মুহাম্মদ ইল্য়াসের (র.) (১৮৮৫-১৯৪৪) উদ্যোগে ১৯২০ সালে দিল্লীতে তাবলীগ জামা‘আতের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে উপমহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন ও সংগঠনে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি মুসলমানদেরকে ইসলামের মৌল বিশ্বাসসমূহে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল করা এবং ধর্মের মৌল অনুশাসনসমূহ মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত করার লক্ষ্যে এ আন্দোলন কাজ করে চলছে।
বাংলাদেশে যেসব সংগঠন ইসলাম ধর্মের যথাযথ চর্চার জন্য কাজ করছে, তন্মধ্যে তাবলীগ জামা‘আত অন্যতম। পঞ্চাশের দশকে মাওলানা আবদুল আজীযের প্রচেষ্টায় ঢাকা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এ জামা‘আতের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এর কর্মকান্ড আরও জোরদার হয়। বর্তমানে বিশ্বের সকল দেশে তাবলীগের কাজ চলছে, বাংলাদেশেও এর কর্মকান্ড ব্যাপক ও শক্তিশালী।
তাবলীগ জামা‘আতের কার্যক্রম ছয়টি উসুলকে (মূলনীতি) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেগুলি হচ্ছে: কালিমা (ঈমান), সালাত (নামায), ‘ইল্ম (জ্ঞানচর্চা) ও যিকর, ইকরামূল মুসলিমীন (মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য), ইখলাসে নিয়ত (সংকল্পের একনিষ্ঠতা) এবং তাবলীগ। এ ছয় মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তাবলীগি পাঠ্য প্রণীত হয়েছে। এ ছয়টি মূলনীতি মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করা ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করাই তাবলীগ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য। তাবলীগের কাজে যখন একাধিক ব্যক্তি একত্রিত হয় তখন সেই সমাবেশকে বলা হয় তাবলীগ জামা‘আত। এতে অংশগ্রহণের ফলে দ্বীনের প্রতি মহান দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, দায়িত্ব পালনে সাহস সঞ্চয়, সামষ্টিক জীবনযাপন এবং ইসলামি জীবনধারা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান লাভ হয়।
তাবলীগ একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। এর বিশ্বকেন্দ্র দিল্লিতে অবস্থিত। তাবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ এ কেন্দ্র পরিচালনা করে। বাংলাদেশে তাবলীগ জামা‘আতের প্রধান কেন্দ্র (মারকায) ঢাকার কাকরাইল মসজিদে অবস্থিত। দেশের সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে তাবলীগ জামা‘আতের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। এর স্থানীয় ইউনিটসমূহ স্ব-স্ব এলাকার একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষ তাবলীগে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে মহিলাদের জন্য পৃথক কোনো জামা‘আত নেই। তাবলীগের কোনো অঙ্গ সংগঠনও নেই।
মসজিদকে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী তাবলীগ জামা‘আতের কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং তাবলীগিদের ভাষায় এ মসজিদকে বলা হয় মারকায। তাবলীগ জামা‘আতের রুটিন এমনভাবে প্রণীত হয় যাতে প্রত্যেক তাবলীগি প্রত্যহ মারকাযের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এভাবে স্থানীয় মারকায এবং কেন্দ্রীয় মারকাযের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাবলীগ জামা‘আতের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়।
তাবলীগ জামা‘আতে ইজতেমা বা সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাবলীগিরা যিক্র, বয়ান (ধর্মীয় বক্তৃতা) ও কর্মতৎপরতা পরিচালনা বিষয়ক পরামর্শের জন্য ইজতেমায় মিলিত হয়। প্রতি বছর ঢাকার অদূরে টঙ্গিতে যে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশের লাখ লাখ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এটি সমগ্র বিশ্বে তাবলীগের সবচেয়ে বড় ইজতেমা; তাই এটি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে পরিচিত। বার্ষিক ইজতেমা ছাড়াও যেসব স্থানে তাবলীগের কাজ মোটামুটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেসব স্থানে সাপ্তাহিক ইজতেমাও (সাধারণত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে) অনুষ্ঠিত হয়।
তাবলীগ জামা‘আতে যিম্মাদারির (নেতৃত্ব) ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। যিম্মাদারকে ইসলাম নির্দেশিত নেতৃত্বের গুণাবলিসহ বিশেষভাবে ধৈর্যশীল, বিনয়ী, মিষ্টভাষী, উচ্চ মনোবলসম্পন্ন ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী হতে হয়। যিনি এসব গুণাবলি অর্জনসহ তাবলীগের কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে বেশি সময় ব্যয় করেন তিনিই নেতৃত্ব লাভ করেন। তাবলীগ সংগঠনের সর্বস্তরের যিম্মাদারকে পরামর্শ দানের জন্য শূরা বা পরামর্শ সভা গঠন করা হয়। প্রধান আমীর তাঁর শূরা-সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সকল কাজ পরিচালনা করেন এবং অনুসারীরা তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে চলেন।
ইসলামের খেদমত ও হেফাজত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। তাবলীগিদের মতে, এ কাজ তাবলীগের মাধ্যমে সর্বোত্তমভাবে সম্পন্ন করা যায়। তাবলীগ জামা‘আতের নিয়ম অনুযায়ী একাজ দুভাবে সম্পন্ন করতে হয়: মোকামী (স্থানীয় বা আঞ্চলিক) কাজ ও তাবলীগি সফর। যেকোনো একটি অঞ্চলের কয়েকজন লোকের সমন্বয়ে মোকামী জামা‘আত গঠন করা যায়। এ জামা‘আতের কাজ একটি নির্দিষ্ট সময়ে এলাকাস্থ মসজিদে প্রতিদিন সম্পাদন করা যেতে পারে। আর সপ্তাহে অন্তত একদিন (সাধারণত বৃহস্পতিবার) তাবলীগিরা নিজ এলাকায় অথবা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গিয়ে তাবলীগে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য জনসাধারণকে আহবান জানান। [হাসান মোহাম্মদ]