হানাফি, মুনশি আজিমুদ্দিন
হানাফি, মুনশি আজিমুদ্দিন (১৮৩৮-১৯২২) বাংলা পুথি সাহিত্যের অন্যতম লেখক ও সমাজসংস্কারক। ১৮৩৮ সালে বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানাধীন গোজাদিয়া গ্রামে এক বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মুনশি বোরহানউল্লাহও ছিলেন একজন সাহিত্যরসিক ব্যক্তি। তাঁর জনৈক পূর্বপুরুষ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে ঢাকায় মছলত উজির ছিলেন এবং পরবর্তী কোনো এক সময় তিনি জঙ্গলবাড়ি জমিদারির অধীন গোজাদিয়ায় বসতি স্থাপন করেন।
পারিবারিক পরিবেশে এবং স্থানীয় মক্তবে পড়াশোনা শেষে মাত্র ১১ বছর বয়সে আজিমুদ্দিন বিখ্যাত সংস্কারক মৌলানা কেরামত আলী জৌনপুরী র শাগরেদ হন এবং পরে কলকাতা ও মুম্বাই-এ আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেন। ফরায়েজী আন্দোলন এর ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদ ও জুমার জামাত পুনরায় চালু করা, লোকদেরকে সত্যিকার ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনা এবং ভন্ড পীরদের মুখোশ উন্মোচনে তিনি জৌনপুরীর সঙ্গে কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে তাঁর সঙ্গে আলেমদের বাহাস হয়। তিনি দুবার পদব্রজে (একবার সস্ত্রীক) হজ্জ পালন করেন।
আজিমুদ্দিন মোট ৪৫টি পুথি রচনা করেন। ইসলামের বিজয়, ধর্মীয় সমস্যা, নারী অধিকার, রোম্যান্টিক কাহিনী, দুঃখ, ভালবাসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর্মফল দর্শন ইত্যাদি বিষয় তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: আসকনামা (১৮৬৫), কাজীনামা (১৮৬৫), নাজাতুল ইসলাম (১৮৭০), গজবনামা (১৮৯৭), ১৩০০ সনের আকালনামা, বাংলা বার সলার মানে, কলির ধর্ম, মাওলানা আবদুল হাই ও আজিমুদ্দিনের বাহাছ, রছুলের কুর্সীনামা, দেশের শোভা (১৮৮১), দুঃখের সাগর (১৯১৩) ইত্যাদি। উল্লিখিত পুথিগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি আরবি ও উর্দু ভাষায় রচিত। আরবি ইতিহাসবিদ আল ওয়াকিদী (৭৪৭-৮২২) রচিত ফতহুশাম তিনি উর্দু থেকে বাংলায় তর্জমা করেন। কলকাতা থেকে এর প্রথম খন্ড তাঁর নামে প্রকাশিত হলেও পরের খন্ডগুলি জনাব আলী নামক একজন লেখক নিজের নামে প্রকাশ করেন। ব্রিটেনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে আজিমুদ্দিনের বেশ কয়টি পুথি সংরক্ষিত আছে। তৎকালীন বাংলার মুসলমান সমাজে বাংলা, উর্দু-হিন্দি, আরবি-ফারসি মিশ্র ভাষায় রচিত এসব গ্রন্থের বিশেষ চাহিদা ছিল। আজিমুদ্দিন সমাজের সে চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। তাঁর ভাষা সহজবোধ্য ছিল।
ছন্দ সম্পর্কে আজিমুদ্দিনের ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি তাঁর পুথিতে পয়ার, ত্রিপদী, পয়ার রাগিণী, লঘু ত্রিপদী, পয়ার লাচারি, খেদ ইত্যাদি ছন্দ ব্যবহার করেছেন। ১৯২২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম]