টেলিভিশন নাটক
টেলিভিশন নাটক টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচারিত নাটক। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে মঞ্চ ও বেতারের পাশাপাশি এক সময় টেলিভিশনেও নাটক প্রচার শুরু হয়। মঞ্চনাটক, বেতারনাটক ও টেলিভিশন নাটকের মধ্যে তিনটি মৌলিক পার্থক্য হলো: মঞ্চনাটকে সবকিছুই প্রত্যক্ষ, বেতারনাটকে সবকিছুই পরোক্ষ, আর টেলিভিশন নাটক পরোক্ষ হলেও এতে প্রতিবিম্বের মাধ্যমে চরিত্রসমূহ দৃশ্যমান হয়। আঙ্গিকগত দিক থেকে টেলিভিশন নাটক চলচ্চিত্রের অনেকটাই কাছাকাছি। চলচ্চিত্রের মতো টেলিভিশন নাটকেও পাত্র-পাত্রীর উপস্থিতি ঘটে প্রতিবিম্বের মাধ্যমে। এ প্রতিবিম্বের আকার ও কোণ নির্বাচন এবং সামগ্রিক কম্পোজিশন নির্মাণে ক্যামেরার বিশেষ ভূমিকা থাকে। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র নির্মাণের তত্ত্ব কিছুটা অনুসৃত হয়। টেলিভিশন নাটকের ব্যাপ্তি হয় সাধারণত এক ঘণ্টা।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে) টেলিভিশন সার্ভিস প্রচলিত হয়। পরের বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো মুনীর চৌধুরী রচিত ও মনিরুল আলম পরিচালিত একতলা ও দোতলা নামক হাস্যরসাত্মক নাটকটি প্রচারিত হয়। এ নাটকে অভিনয় করেন লিলি চৌধুরী, ফেরদৌস আরা, ডলি ইব্রাহিম, খন্দকার রফিকুল হক ও রামেন্দু মজুমদার।
প্রথম দিকে টেলিভিশন নাটক প্রচারে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ভিটিআর সুবিধা না থাকায় যেকোনো নাট্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো এবং সীমিত উপকরণের মাধ্যমে নাটকের দৃশ্যপট নির্মাণ ও প্রচার করা হতো। বেশ কিছুকাল পরে ভিটিআর সুবিধা সংযুক্ত হলেও এডিটিং সুবিধা না থাকায় ধারণকৃত দৃশ্য এডিট করা হতো না। আউটডোর শুটিং তখন সম্ভব ছিল না। আউটডোরের দৃশ্যসম্বলিত সেট শিল্পীদের দিয়ে স্টুডিওতে অাঁকিয়ে তার সামনে অভিনয় করানো হতো। পরবর্তীকালে অবশ্য রামপুরায় টেলিভিশনের নিজস্ব ভবন, মহড়া কক্ষের সুবিধা, একাধিক স্টুডিও ব্যবহারের সুযোগ, আউটডোর শুটিং-এ যাতায়াতের জন্য নিজস্ব যানবাহন ব্যবস্থা, দক্ষ সেট ডিজাইনার, প্রয়োজনীয় ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানের উপস্থিতি, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণের উন্নত প্রযুক্তি প্রভৃতি টেলিভিশন নাটককে অনেকটা উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসে। বর্তমানে কোনো টেলিভিশন নাটক সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না; স্টুডিওতে রেকর্ড করার পর প্রয়োজনীয় সম্পাদনা শেষে প্রচারিত হয়।
টেলিভিশন নাটক উৎকৃষ্ট বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানসমূহের অন্যতম। এ কারণে প্রতিসপ্তাহে নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক নাটক, একাধিক পর্বে বিভক্ত ধারাবাহিক নাটক, বিশেষ বিশেষ দিবস, যেমন: বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ঈদ, বড়দিন, দুর্গাপূজা, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্ম-মৃত্যু দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে বিশেষ নাটক প্রচারিত হয়। প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকগুলির মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি হলো ত্রিরত্ন, সকাল সন্ধ্যা, সময় অসময়, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, সংশপ্তক, এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে রক্তকরবী, ইডিয়ট, শাহজাদীর কালো নেকাব, এখানে নোঙ্গর, সুপ্রভাত ঢাকা, দূরবীণ দিয়ে দেখুন, বাবার কলম কোথায়, আয়নায় বন্ধুর মুখ, ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি।
টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকগুলির বিষয়বস্ত্ত বিচিত্র রকমের, যেমন: পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, সমাজ সচেতনতা, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, প্রেম-ভালোবাসা, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি। তবে পারিবারিক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্ত্ত এবং সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে যেসব নাটক রচিত ও সম্প্রচারিত হয়েছে, সেসব নাটক দর্শকদের কাছে অধিক মাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়েও বেশকিছু নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। সেসব নাটকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং, গেরিলা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিশ্বাস সম্পর্কিত ধ্যান-ধারনা ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে।
নববইয়ের দশক থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত টেলিভিশনের অধিকাংশ নাটক রচিত হয়েছে মানবীয় প্রেম-ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। তবে গ্রামবাংলার জীবনচিত্র, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাহিনী, শহরের নোংরা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর চিত্র, শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা, স্বল্প আয়ের ব্যক্তিবর্গের পারিবারিক দ্বন্দ্ব, জীবন-সংঘাত, গ্রাম্য ও শহুরে জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিংবা পার্থক্য নিয়ে রচিত বেশকিছু নাটক বিষয়বস্ত্ততে বৈচিত্র্য এনেছে।
সম্প্রতি টেলিভিশনে এক ধরনের ক্ষুদ্র নাটক প্রচারিত হচ্ছে যেগুলিকে বলা হয় শিক্ষামূলক নাটক। বৃক্ষরোপণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, শিক্ষা, কৃষি, পশু-পাখি পালন ও সংরক্ষণ, মৎস্যচাষ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে এ নাটকগুলি রচিত হয়। এগুলির ব্যাপ্তিকাল হয় সাধারণত ১০-১৫ মিনিট। সাধারণ জনগণকে উপরিউক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এ নাটকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টেলিভিশন নাটকে প্রযোজক ও নাট্যকার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন জামান আলী খান, ওয়ালিউল্লাহ ফাহমী, খালেদা ফাহমী, মনিরুল আলম, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, মোস্তফা মনোয়ার, দীন মোহাম্মদ, মোস্তাফিজুর রহমান, সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, বরকতউল্লাহ, মমিনুল হক, নওয়াজীশ আলী খান, আতিকুল হক চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মামুনুর রশীদ, হুমায়ূন আহমেদ, সাঈদ আহমেদ, সেলিম আল দীন প্রমুখ।
শিল্পী হিসেবে যাঁরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, লিলি চৌধুরী, রওশন জামিল, মিরানা জামান, জাহানারা আহমেদ, আয়েশা আকতার, মোহাম্মদ জাকারিয়া, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আবুল খায়ের, আবুল হায়াত, আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদার, মাসুদ আলী খান, জহিরুল হক, আরিফুল হক, নাজমুল হুদা বাচ্চু, রিনি রেজা, সৈয়দ আহসান আলী (সিডনী), মিতা চৌধুরী, দিলশাদ খানম, কেয়া চৌধুরী, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, ফেরদৌসী মজুমদার, কেরামত মাওলা, আল মনসুর, জামালউদ্দিন হোসেন, সারা যাকের, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আফজাল হোসেন, আফরোজা বানু, লাকী ইনাম, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, হুমায়ূন ফরিদী, সুবর্ণা মোস্তফা প্রমুখ। [জিল্লুর রহমান জন]