টেলিভিশন
টেলিভিশন বিগত শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার যা কিনা বিশ্বসমাজকে অভূতপূর্বভাবে বদলে দিয়েছে। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে টেলিভিশন (টিভি) এখন মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্বকে গৃহে উপস্থিত করছে, এর ফলে পৃথিবী আজ পরিণত হয়েছে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ। টিভি সারা বিশ্বের মানব সভ্যতাকে যে এক সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম, তা ফিলিপিনস-এ জন্মগ্রহণকারী মার্কিন মিডিয়া বিশেষজ্ঞ Marshall Mcluhan তাঁর ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ তত্ত্বে ষাটের দশকেই তুলে ধরেছিলেন।
বিগত শতাব্দীর বিশের দশকের শেষ দিকে উদ্ভাবিত টেলিভিশন প্রযুক্তির উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন Arthur C Clerk। তিনি ১৯৪৫ সালে বলেছিলেন যে, তিনটি মহাসাগরের ওপর তিনটি উপগ্রহ স্থাপন করা হলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তকে টেলিভিশনের পর্দায় তুলে ধরা সম্ভব। বর্তমানে পৃথিবীর চারপাশে শত শত উপগ্রহের পরিভ্রমণের ফলস্বরূপ আমরা পাচ্ছি অসংখ্য স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই উন্নত দেশগুলিতে টেলিভিশনের নিয়মিত সম্প্রচার শুরু হয়। আর উপমহাদেশে টিভি এসেছে তারও প্রায় দু’দশক পরে। বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বেসরকারি উদ্যোগে টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। ঢাকা শহরের ডিআইটি বর্তমান রাজউক ভবন থেকে মাত্র তিনশ ওয়াট ট্রান্সমিটারের সাহায্যে ঢাকা ও এর আশপাশে দশ মাইল এলাকার জন্য প্রতিদিন তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। পাকিস্তান সরকার ঢাকা টেলিভিশন সেন্টারকে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন হিসেবে গ্রহণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা বিবেচনা করে ১৯৭২ সালে টেলিভিশনকে জাতীয়করণ করে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামকরণ করা হয়। পূর্বে এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু সীমিত সম্প্রচার এলাকা এক্ষেত্রে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থানে উপকেন্দ্র স্থাপন এবং বিদ্যুতের সম্প্রসারণের ফলে এ বাধা অনেকটা দূর হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ৬ মার্চ ডিআইটি থেকে টেলিভিশন কেন্দ্র রামপুরার বৃহত্তর পরিমন্ডলে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে ১২টি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে সারাদেশে পঁচানববই ভাগেরও বেশি এলাকা টিভি সম্প্রচারের অধীনে এসেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামই প্রতিদিন সীমিত সময়ের জন্য নিজস্ব অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে। বাকি সব উপকেন্দ্র ঢাকার অনুষ্ঠান ‘রিলে’ করে থাকে। এ ‘রিলে’ উপকেন্দ্রগুলি হচ্ছে সিলেট, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী এবং নোয়াখালী। এসবের মধ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় ট্রান্সমিটার সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ২০ কিলোওয়াট। সবচেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন হচ্ছে সাতক্ষীরা ২ কিলোওয়াট। বাকি সবগুলি ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন।
বিটিভির অবকাঠামোগত উন্নয়নে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হচ্ছে ১৯৮০ সালে রঙিন অনুষ্ঠান সম্প্রচার চালু। বর্তমানে বিটিভিতে আটটি বিভাগে মোট ১,৫২০ জন নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারি কর্মরত। বিভাগওয়ারি জনবলের বিন্যাস হচ্ছে: অনুষ্ঠান ২০৪ জন, সংবাদ ৩২ জন, প্রকৌশল ৩৭৮ জন, ক্যামেরা ১৩২ জন, ডিজাইন ১১৬ জন, প্রশাসন ৫৪০ জন, হিসাব শাখা ৯৫ জন এবং সেলস ২৩ জন।
বিটিভির সম্প্রচার পরিধি বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে। দেশে বিভিন্ন স্থানে আরও চারটি নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলি রাজশাহী, রাজবাড়ী, রাঙ্গামাটি ও উখিয়াতে অবস্থিত। এর মধ্যে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামের মতো নিজস্ব অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরিকল্পনা রয়েছে। সবগুলি উপকেন্দ্র চালু হলে দেশের প্রায় সর্বত্র আরও কার্যকরভাবে সম্প্রচার সম্ভব হবে। তবে সম্প্রচার এলাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি টেলিভিশনকে গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করা আবশ্যক। সাধারণ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো এবং তাদের টিভি সেট ক্রয়ক্ষমতা বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়। বর্তমানে সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ২৬ লাখ। এ সংখ্যার সাথে টিভির গ্রাহক সংখ্যা এবং পল্লী এলাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্পহারে সরকারের প্রচারিত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান পৌঁছানোর হিসাবটি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত।
দেশে মোট টিভি সেটের সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারিভাবে লাইসেন্সকৃত সেট সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ হলেও ধারণা করা হয় প্রকৃত টিভি সেট সংখ্যা হবে বিশ লাখের মতো। সে হিসেবে এ দেশে প্রতি ৬৫ জনের জন্য রয়েছে মাত্র একটি টিভি সেট। সংখ্যাগত অপ্রতুলতার পাশাপাশি আরও সমস্যা হচ্ছে বণ্টন। বেশির ভাগ টিভি সেটই শহরাঞ্চলে। ফলে পল্লী অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে যাচ্ছে এর বলয়ের বাইরে।
সংখ্যাগত অপ্রতুলতার সাথে প্রযুক্তির পশ্চাৎপদতা আরেকটি বড় সমস্যা। ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ের এ যুগেও আমাদের টেলিভিশন টিঅ্যান্ডটির মাইক্রোওয়েভ নির্ভর। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশও যেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে, আমাদের টেলিভিশন সেখানে নিজ দেশের সকল জনগণের কাছেই এখন পৌঁছতে পারে নি। ফলে আমরা সাংস্কৃতিক একমুখিতার শিকার হচ্ছি। তার চেয়েও ভয়াবহ প্রভাব হচ্ছে ‘বাণিজ্যিক আগ্রাসন’। তাদের পণ্য আমাদের অতিপরিচিত যা মুক্তবাজার অর্থনীতির উদ্দেশ্য পূরণ করছে। ‘স্যাটেলাইট টিভি’র বদৌলতে বাজার দখল করার জন্য এখন আর দেশ দখল করার প্রয়োজন হয় না।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচারে বিকাশের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে বেতবুনিয়া ও তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের সাহায্যে বিটিভি বিশ্বের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে। তাছাড়া বিনিময় চুক্তির অধীনে বিটিভি এশিয়া-প্যাশিফিক ব্রোডকাস্টিং ইউনিয়ন (এবিইউ), সার্ক অডিও-ভিজুয়াল প্রোগ্রামসহ এশিয়া-প্যাশিফিক ইন্সটিটিউট ফর ব্রোডকাস্টিং ডেভেলপমেন্ট (এআইবিডি) এবং কমনওয়েলথ ব্রোডকাস্টিং এ্যাসোসিয়েশন (সিবিএ) থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সংবাদচিত্র পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের স্যাটালাইট ভিত্তিক চ্যানেল বিটিভি ওয়ার্ল্ড সারা বিশ্বে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। টিভি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি টিভি কোম্পানিগুলিকে অনুমোদন প্রদান করে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আনেকগুলি বেসরকারি চ্যানেল চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, চ্যানেল আই, একুশে টিভি, এনটিভি, দেশ টিভি, দিগন্ত টেলিভিশন, আরটিভি, বাংলাভিশন, ইসলামিক টিভি, মোহনা টিভি, মাছরাঙ্গা, বৈশাখী, ইন্ডিপেনডেন্ট, চ্যানেল ২৪ এবং সময় সংবাদ উল্লেখযোগ্য। এসব টেলিভিশন চ্যানেলগুলি নিয়মিতভাবে সংবাদ, বিনোদনমূলক, শিক্ষামূলক, সচেতনামূলক, রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
‘প্যাকেজ’ অনুষ্ঠান পরিবেশনের মাধ্যমে বিটিভির অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। সর্বোপরি বিটিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। [এম. সাইফুল্লাহ্]