জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী
জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচির অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন পর্যালোচনার দায়িত্বে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত কর্মকর্তা। জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারীর ধারণাটি সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং জেলায় জেলায় এ ধরনের বিশেষায়িত বিভাগের কার্যালয় সংখ্যা বাড়ছে। অনেক বিভাগের কার্যালয় রাজধানীর বাইরে মাঠ পর্যায়ে স্থাপন করার ফলে সমন্বয় সাধনের সমস্যা দেখা দেয়। এরই পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকার রোনাল্ড কমিটি নামে খ্যাত বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এনকোয়ারি কমিটি গঠন করে। বাংলার প্রশাসন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ কমিটি মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির সমন্বয় সাধনে জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারীকে ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের সঙ্গে কর্তৃত্ব প্রয়োগের সীমারেখা যাচাইয়ের প্রয়োজনের কথা তুলে ধরে। অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও অন্যান্য বিভাগের টেকনিক্যাল পদ্ধতি থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের কর্তৃত্বের বিভাজনের জন্য রোনাল্ড কমিটির সুপারিশমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় (১৯৫৫-৬০) জেলার উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অবস্থান শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। ষাটের দশক পর্যন্ত জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারীর ভূমিকা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের সমন্বয়ে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠিত হয় এবং বিশেষায়িত সেবা বিভাগের প্রধানদের কমিটির সদস্য করা হয়।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে সরকার জেলা পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত সমন্বয়কারীদের অভিষিক্ত করণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সংসদ-সদস্যদের জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের পদবি ও পদমর্যাদা ছিল উপমন্ত্রীর সমতুল্য। এছাড়া মন্ত্রীরা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি নিয়োজিত হতেন। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সামরিক আইন জারীর পর পরই সরকার বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের প্রশাসনিক বিন্যাসের বিস্তারিত রূপরেখা প্রকাশ করে। এ রূপরেখার আওতাধীন বিভাগ, জেলা, মহকুমা এবং থানা পর্যায়ে উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সাধারণ মাঠ কর্মকর্তারা যেমন কমিশনার, জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক এবং সার্কেল অফিসাররা (উন্নয়ন) প্রত্যেকেই নিজ নিজ পর্যায়ে যথাক্রমে কমিটির চেয়ারম্যান হতেন এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, উন্নয়ন সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থার সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তাগণ কমিটির সদস্য থাকতেন। কমিটির কার্যাবলির মধ্যে ছিল: ক. নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত সকল উন্নয়ন কর্মসূচি এবং বাস্তবায়নাধীন সকল প্রকল্পের সামগ্রিক সমন্বয় সাধন ও মনিটরিং করা; খ. সকল আন্তঃবিভাগ/আন্তঃসংস্থার প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন সমন্বয় সমস্যা সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করা; গ. প্রকল্প পরিদর্শন এবং তা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার পথে প্রতিবন্ধকতা অপসারণের প্রস্তাব গ্রহণ; ঘ. আর্থিক ও ভৌতিক সকল উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা এবং এধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচির আর্থসামাজিক প্রভাব অবহিত করা।
এসব কমিটির সভায় উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। কমিটির চেয়ারম্যানদের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছিল তাদের নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত প্রকল্প পরিদর্শন করে বাস্তবায়নের অগ্রগতি সন্তোষজনক এ মর্মে নিশ্চিত হওয়া। প্রকল্প সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি এবং তা সরকারের নিকট পেশ করার ক্ষমতাও তাদের দেয়া হয়। এসব প্রতিবেদনে উত্থাপিত সমস্যা ও ইস্যুর প্রতি মনোযোগ দেয়া ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের জন্য আবশ্যিক। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করাও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয়মূলক কার্যাবলির দায়িত্ব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত হয়। তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরকে কমিটির চেয়ারম্যান এবং জেলা পর্যায়ের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচির বিভাগীয় প্রধানদের সদস্য করে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এ কমিটি আন্তঃসংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তির প্রধান ফোরাম হিসেবে কাজ করে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর অবশ্য জেলা পর্যায়ের কৃষি ঋণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি বিষয়ক ত্রিশটি কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন। [এ.এম.এম শওকত আলী]