জিরাতি
জিরাতি শব্দটি বাংলায় প্রাক্-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমলে জমি ভোগদখলের প্রকৃতি বোঝানোর জন্য চালু ছিল। জিরাত আরবি শব্দ, এর অর্থ চাষোপযোগী জমি অথবা যে জমিতে করদাতা রায়তগণ বসতি স্থাপন করেছে। মধ্যযুগে বাংলায় যখন জমি ও মানুষের অনুপাত মানুষের অনুকূলে ছিল এবং প্রকৃত কর্ষিত জমির উপর ভিত্তি করে খাজনা আরোপ ও আদায় করা হতো তখন মুগল দলিলাদিতে অনাবাদি জমির বিপরীতে আবাদি জমি বোঝাতে জিরাত শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। জিরাতি জমি বসতবাড়ি ও বাগানের জন্য ব্যবহূত জমি থেকেও আলাদা ছিল।
কিন্তু সতেরো শতকের প্রথম থেকে শব্দটির অর্থ ও প্রয়োগে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বিহারে জিরাতি জমি ধীরে ধীরে ফসলি জমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বাংলায় এটি হয়ে যায় আবাদ জমি। তবুও মৌসুম অনুসারে অন্যগ্রাম ও এলাকা থেকে আসা রায়তদের দ্বারা চাষ করা জমি বোঝানোর জন্য জিরাতি শব্দটির ব্যবহার অব্যাহত থাকে। তাদেরকে জিরাতি রায়ত বলে অভিহিত করা হয়, কেননা তারা ফসল মৌসুমে আসত এবং ফসল ওঠানোর পর আবার যে যার বাড়ি ফিরে যেত। সাধারণত সীমান্ত এলাকার জেলাগুলিতে জিরাতি রায়তদের দ্বারা জমি চাষ করা হতো।
ঊনিশ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে জিরাতি রায়তেরা পূর্ব বাংলার সুন্দরবন, বরেন্দ্র ও হাওর অঞ্চলে জমি উদ্ধার ও চাষোপযোগী করে তোলার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জমি পেতে অতি আগ্রহী রায়তেরা পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে এতদঞ্চলে আসত, ভূমি মালিকদের সহায়তায় ওই মৌসুমে থাকার জন্য অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলত, জমি চাষ করত এবং অবশেষে উৎপন্ন ফসলের ভাগ নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যেত। প্রচলিত হারে জমির মালিক ও জিরাতি রায়তদের মধ্যে উৎপন্ন ফসল ভাগ করা হতো। সাধারণত জমির মালিকগণ সুবিধাজনক শর্ত দিয়ে জিরাতি রায়তদের জমি আবাদের জন্য আকৃষ্ট করার প্রয়াস পেত, কেননা তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া জমি অনাবাদি পড়ে থাকত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির ফলে জিরাত জমির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে হাওর এলাকায় যেখানে দিনমজুরের খুব অভাব সেখানে ফসল কাটার মৌসুমে যে সকল শ্রমিক দলে দলে আসে তাদেরকে জিরাতি বলা হয়। ফসল কাটা, মাড়াই ও গোলাজাত করার পর তারা তাদের ভাগ পেয়ে থাকে। [সিরাজুল ইসলাম]