জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল। সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। দেশের রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরী। জেনারেল এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগ নেন। রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে জনদল নামে রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৩ সালের ১৭ মার্চ উনিশ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকায় এক সমাবেশে জনদল নামে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জনদলের কমিটি গঠন বিলম্বিত হয়। বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে আহবায়ক এবং এম.এ মতিনকে সাধারণ সম্পাদক করে জনদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী জনদল থেকে সরে দাঁড়ান। পরবর্তী সময়ে জনদলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত হন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন রিয়াজউদ্দীন আহমদ (ভোলা মিয়া)।
দলগঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এরশাদের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালের ১৩ জুন জাতীয় ফ্রন্ট নামে একটি নতুন মোর্চা গঠিত হয়। এ ফ্রন্টে বিএনপি থেকে শাহ আজিজ গ্রুপ, জনদল ও মুসলিম লীগের একাংশ, গণতান্ত্রিক পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি এবং নির্দলীয়ভাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যোগ দেন। ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটিতে সদস্য ছিলেন ১৩ জন।
১৯৮৫ সালের ১ অক্টোবর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সীমিত আকারে তুলে নেওয়ার পর মাত্র ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় ফ্রন্টের বিলুপ্তি ঘটানো হয়। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ৭ ও ১৫ দলীয় জোটকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহবান জানান। ১৫ দলীয় জোটের পাঁচটি দল এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। ১৯৮৬ সালের ৭মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৭৬টি আসনে। এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্দেহ ও কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ১৯৮৭ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। পুনরায় জাতীয় পার্টির সরকারের অধীনেই ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান সব বিরোধী দলই এ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১ আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর দেশে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এরশাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল বর্জন করে।
১৯৮৯ সালে পুনরায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এ অবস্থায় এরশাদ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এরশাদ বিদায় নেন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ। পরে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গ্রেফতার হন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৩৫টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন লাভ করে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয়। এ দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এরশাদ ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন। জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে এসে নেতৃত্বের কোন্দলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়। দলটি এখন এরশাদ গ্রুপ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গ্রুপ ও নাজিউর রহমান মঞ্জু গ্রুপে বিভক্ত। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এরশাদ গ্রুপ ১৪টি এবং আনোয়ার হোসেন গ্রুপ ১টি আসন লাভ করে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদে ২৭ টি আসন এবং মোট ভোটের ৭% লাভ করে। ফলে এখন জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল। বর্তমানে (২০১০) জাতীয় পার্টির সভাপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং এর সাধারণ সম্পাদক এ.বি.এম রুহুল আমিন হাওলাদার। [মনু ইসলাম]