জয়ন্তিয়া
জয়ন্তিয়া সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এরা সিনটেং নামেও পরিচিত। এককালে সিলেটের উত্তরাঞ্চলে এদের বসবাস ছিল। কিন্তু দেশ বিভাগের পর তাদের একটি বড় অংশ আসামের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে চলে যায় এবং সেখানেই অধিকাংশ জয়ন্তিয়ার বসবাস। এদেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ সিলেটের জৈন্তিয়াপুর থানায় বসবাস করছে। বর্তমানে জয়ন্তিয়াদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে যে সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথম আগমন করে বসতি স্থাপন করে জয়ন্তিয়ারা তাদের মধ্যে অন্যতম। অনেকের ধারণা জয়ন্তিয়ারা খাসীদের একটি শাখা। তবে সেটি সঠিক নয়। কারণ খাসীরা মন্-খেমের গোষ্ঠীর শাখা এবং জয়ন্তিয়ারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর শাখা। কেবল দীর্ঘদিন পাশাপাশি সহাবস্থানের ফলশ্রুতিতেই অনেক ক্ষেত্রে খাসীদের সঙ্গে জয়ন্তিয়াদের সাদৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু সেই সাদৃশ্য দেহাবয়বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জয়ন্তিয়া নামকরণের পিছনে সঠিক কোন তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়না। তবে অনেকের মতে তাদের আদি নাম সিনটেং-এর বিকৃতিরূপ জয়ন্তিয়া। আবার অনেকের মতে তাদের প্রধান উপাস্য দেবী জয়ন্তীর নামানুসারেই জয়ন্তিয়া নামকরণ হয়েছে। উল্লেখ্য দেবী জয়ন্তী দুর্গাদেবীর অন্যরূপ। জয়ন্তীরা নিজেদেরকে প্নার নামেও পরিচয় দিয়ে থাকে।
জয়ন্তিয়াদের নিজম্ব ভাষা থাকলেও কোন বর্ণমালা নেই। এদেশে বসবারকারী জয়ন্তিয়ারা বাংলা ভাষাতেই বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করে। তবে তাদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে জয়ন্তিয়ারা এগিয়ে। এদের শিক্ষার হার প্রায় ৬০%। বর্তমানে অনেকেই বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। মেঘালয়ের শিলং-এ জৈয়ন্তিয়া পরিবারের কিছু ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করছে। নিজেদের মধ্যে জয়ন্তিয়ারা নিজস্ব ভাষায় কথা বললেও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকেই ব্যবহার করে।
খাসী এবং জয়ন্তিয়া পুরুষদের পোশাক একই ধরনের। তবে এদেশে বসবাসকারী জয়ন্তিয়া পুরুষেরা বাঙালিদের মতোই তাদের পোশাক পরিধান করে। অবশ্য মহিলাদের আলাদা ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে। হাজং এবং কোচ মহিলাদের মতো তারা উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত এক প্রস্থ কাপড় বুকের উপর পেঁচিয়ে পরে। তবে জয়ন্তিয়া মহিলারা আরেক প্রস্থ কাপড়ের সাহায্যে কাঁধের একপাশে পিঁট দিয়ে ওড়নার মতো ব্যবহার করে যা খাসী মহিলারাও করে থাকে। অবশ্য অধিকাংশ জয়ন্তিয়া মহিলা বর্তমানে শাড়ী জামা পরতেই বেশি অভ্যস্থ। কিন্তু ঘরোয়া পরিবেশে তারা তাদের নিজস্ব পোশাক পরিধান করতেই বেশি পছন্দ করে। সোনা এবং রূপার তৈরি গহনা জয়ন্তিয়া মহিলারা পছন্দ করে। জয়ন্তিয়ারা পরিস্কারপরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্য সচেতন।
জয়ন্তিয়া সম্প্রদায়ের মূল পেশা কৃষিকাজ। তারা পান চাষ, সুপারি চাষ করে। এছাড়া এলাকাভিত্তিক ব্যবসাবাণিজ্যও করে। জয়ন্তিয়া সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। পরিবারে মায়েরাই প্রধান। পরিবারের ছেলেমেয়েরা মায়ের পদবী ধারণ করে এবং মেয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। জয়ন্তিয়া সমাজ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলি হলো: লামিন, লাংডো, নায়াং, সার্থী, কায়াং, লানং প্রভৃতি। গোত্র্রপ্রথার প্রচলন থাকলেও জয়ন্তিয়া সমাজে ভেদাভেদ প্রথা নেই। বৈবাহিক এবং সামাজিক নিয়মকানুন রক্ষা করার জন্যই মূলত গোত্রপ্রথার প্রচলন। নিজ গোত্রে বিবাহ জয়ন্তিয়া সমাজে নিষিদ্ধ। সামাজিক সমস্যাদি নিরসনের জন্য জয়ন্তিয়া সমাজে সামাজিক পঞ্চায়েত পদ্ধতি বিদ্যমান। পঞ্চায়েত প্রধানের নেতৃত্বেই সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সামাজিক বিচার শালিসের কাজ পরিচালিত হয়। সামাজিক সমস্যাদির ক্ষেত্রে সামাজিক পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে বিবেচিত। সমাজের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হন। ভাত জয়ন্তিয়াদের প্রধান খাদ্য। ভাতের সঙ্গে তারা বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি, মাছ, মাংস খেতে পছন্দ করে। শূকরের মাংস তাদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য। এছাড়া হাঁসমুরগি, খাসি প্রভৃতির মাংস এবং দুধ ও দুধে তৈরি মিষ্টি তাদের সবার নিকট অতি প্রিয়। তাদের মধ্যে চা পানের প্রচলনও আছে। পান-সুপারির ব্যবহার তাদের সামাজিকতায় অন্যতম একটি অঙ্গ। অতিথি আপ্যায়নে তারা প্রথমেই পান-সুপারি ব্যবহার করে। মদ বা কিয়াদ পানের প্রচলনও জয়ন্তিয়া সমাজে বিদ্যমান। বিভিন্ন মৌসুমী সবজি তারা পছন্দ করে, তবে কচু এবং কন্দ জাতীয় সবজি তাদের নিকট বেশি প্রিয়। শুঁটকি মাছও তাদের পছন্দের খাবার। তাদের রন্ধন প্রণালি বাঙালিদের মতোই।
জয়ন্তিয়ারা ধর্মবিশ্বাসে সর্বপ্রাণীবাদে বিশ্বাসী হলেও তাদের মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রভাব স্পষ্ট। প্রধান উপাস্য জয়ন্তী দেবী, যিনি দেবী দুর্গার ভিন্নরূপ। হিন্দু দেবদেবীর পাশাপাশি তারা তাদের আদিধর্মের দেবদেবীকেও বেশ গুরুত্ব সহকারে পূজা আরাধনা করে। তাদের নির্দিষ্ট কোন উপাসনালয় নেই। এরা প্রকৃতির মাঝেই তাদের আপন আপন দেবদেবীকে খুঁজে পান এবং প্রকৃতির উম্মুক্ত কোলেই সেইসব দেবদেবীকে পূজা আরাধনা করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর একজনই আছেন এবং তিনি অনাদিকাল ব্যাপী ছিলেন, আছেন এবং অনন্তকালব্যাপী থাকবেন। আদিতে ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির সরাসরি যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কালক্রমে মানুষ যখন স্বার্থপর হয়ে উঠলো ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও ক্রমান্বয়ে ছিন্ন হতে থাকলো। শেষ পযর্ন্ত মানুষ ঈশ্বরকে চর্মচক্ষু দিয়ে আর দেখতে পেলোনা এবং এভাবেই মানুষ ঘোর সংসারী হয়ে উঠলো এবং ঈশ্বরচিন্তা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেল। ফলে ঈশ্বর মানুষকে সঠিক পথে, নীতির পথে রাখার জন্য কিছু কিছু নীতিবাক্য শোনালেন আর সেভাবে জীবনযাপনের নির্দেশ দিলেন। যেমন (ক) কামাই ইয়া কা হক্ (সৎপথে উপার্জন কর); (খ) থিপ্ব্রু থিপ্ব্লাই (মানুষকে জান, ঈশ্বরকে জান); (গ) থিপ্কুর-থিপ্খার (নিজের পিতৃমাতৃ উভয়কুলের সবাইকে জান)। জয়ন্তিয়াদের ধারণা ঈশ্বর অবাধ্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু সংখ্যক অনিষ্টকারী দেবদেবীরও সৃষ্টি করলেন, যাদের মূল কাজই হলো রোগশোক, জরাব্যাধি প্রদানের মাধ্যমে মানবজাতিকে শায়েস্তা করা এবং এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা। জয়ন্তিয়ারা নিয়ম করে সেইসব দেবদেবীর ক্রোধ প্রশমনের লক্ষ্যে তাদের পূজা আরাধনা শুরু করলেন। পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, শাস্তি-পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে জয়ন্তিয়া সমাজের একটা স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। সাম্প্রতিককালে জয়ন্তিয়াদের অনেকেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। [সুভাষ জেংচাম]