চড়কপূজা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:৩৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

চড়কপূজা  হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে এটি পালিত হয়। এর অপর নাম নীলপূজা। পশ্চিমবঙ্গের গম্ভীরাপূজা বা শিবের  গাজন এ চড়কপূজারই রকমফের। এ পূজা খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। এ পূজার পুরোহিত হলেন আচার্য ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্র, অর্থাৎ পতিত ব্রাহ্মণ। চড়কপূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা। দানো-বারানো বা হাজারা পূজা করা হয় সাধারণত শ্মশানে। চড়কপূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ।

চড়ক উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে, অর্থাৎ একটি উঁচু খুঁটিতে ভক্ত বা সন্নাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহবায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ ফোঁড়া, অর্থাৎ লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনও কখনও জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনও তা প্রচলিত আছে।

চড়কপূজা আদি লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারাও বটে। এর উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন  শিব ও দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজওয়ালা হনুমান। তার মুখে থাকে দাঁড়ি আর হাতে থাকে কাঠের তরবারি। পুরো দেহ ঢাকা থাকে মাছ ধরার পুরনো জাল দিয়ে, আর মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় আর নাচ-গান পরিবেশন করে। গ্রামবাসীরা তাদের সাধ্যমতো টাকা-পয়সা, চাল-ডাল ইত্যাদি দান করে। কেউবা তাদের এক বেলা খাবারও দেয়।

চড়কপূজার দূশ্য

এভাবে সারা গ্রাম ঘুরে দলটি দান হিসেবে যে দ্রব্যাদি পায় তা দিয়ে হয় চড়কপূজা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

চড়কপূজা
  1.  #চড়কপূজা কত প্রাচীন তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়কপূজার উল্লেখ নেই। বছরের বিভিন্ন সময়ে সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অনুষ্ঠিত ছোট-বড় নানা ধর্মোৎসবের বিবরণে পূর্ণ পনেরো-ষোল শতকে লেখা গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এ উৎসবের উল্লেখ নেই। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, উচ্চস্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। সম্ভবত পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই এ উৎসব প্রচলিত ছিল।

চড়ক প্রধানত হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও এতে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের লোকই অংশগ্রহণ করে। তাই চড়কের মেলা প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে সামাজিক পরিবর্তন ও গ্রামে-গঞ্জে নগরায়ণের বিস্তারের ফলে বর্তমানে লোকসংস্কৃতির এ ধারা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]

আরও দেখুন চৈত্রসংক্রান্তি মেলা