আঞ্জুমান-ই-ওয়াজিন-ই-বাংলা
আঞ্জুমান-ই-ওয়াজিন-ই-বাংলা একটি সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠন। হুগলির ফুরফুরার পীর সাহেব মওলানা আবুবকর সিদ্দিক (১৮৫৯-১৯৩৯), মৌলবি ওয়াহেদ হোসাইন এবং মিহির ও সুধাকর পত্রিকার সম্পাদক মুন্সী শেখ আব্দুর রহিম কর্তৃক ১৯১১ সালে কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা আবুবকর সিদ্দিক ছিলেন আঞ্জুমানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং এর আজীবন সভাপতি। তাঁর মৃত্যুর (১৯৩৯) পর তাঁরই পুত্র মওলানা আব্দুল হাই এর সভাপতি হন। মোসলেম হিতৈষী, ইসলাম দর্শন, হানাফি, শরিয়তে ইসলাম এবং সুন্নাত আল-জামাআত ছিল আঞ্জুমানের মুখপত্র।
শরিয়ার মূলনীতি প্রচার এবং বাংলার মুসলমানদের ইসলামের প্রকৃত রীতিনীতি শিক্ষাদানের জন্য বাংলার হানাফি উলামাদের এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল আঞ্জুমানের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যের পাশাপাশি ধর্মীয় প্রচারণা, সামাজিক সংস্কার এবং মুসলিম উম্মাহর উন্নয়নে কাজ করাও এ সংগঠনের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। আঞ্জুমান সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করে যে, পবিত্র কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে সকল ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে তারা অংশগ্রহণ করবে এবং কোনো বিশেষ সংগঠন বা কোনো সম্প্রদায়ের নীতিমালা বা কর্মপন্থা অনুসরণ করবে না।
আঞ্জুমানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিপুল সংখ্যক বেতনভোগী ও অবৈতনিক ধর্মপ্রচারক নিয়োগ করা হয়। প্রচারকগণ ঘন ঘন বাংলার জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কে বক্তৃতা, মুসলমানদের নিয়মিত নামায আদায়ের জন্য তাগিদ প্রদান, শিরক-বিদাতের ন্যায় অনৈসলামিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা এবং সুদ, ঘুষ ও যৌতুক ইত্যাদি কুপ্রথা পরিহার করতে বলতেন। প্রচারাভিযান কালে তারা বাংলার বিভিন্ন এলাকায় মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, গ্রাম্য এলাকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তির জন্য সালিশি-বোর্ড গঠন, বায়তুল মাল তহবিল গঠন এবং যুব-সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া তাঁরা অমুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচার এবং কাদিয়ানি ও খ্রিস্টান মিশনারি কার্যকলাপ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এ সকল কর্মকান্ড ছাড়াও আঞ্জুমান নেতৃবৃন্দ ও ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে বিশেষত মওলানা রুহুল আমীন (প্রধান প্রচারক), মৌলবি আব্দুল করিম ও মৌলবি ইবরাহিম অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। ইসলাম দর্শন, শরিয়ত ও শরিয়তে ইসলাম পত্রিকায় কাদিয়ানি মুসলমানদের মতবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা নিবন্ধও প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তাঁরা মুহম্মদী ও আহল-ই-হাদীস দলের বিশেষ করে মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁএর ওপর বিরূপ ছিলেন। কখনও কখনও তাঁরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী উলামাদের সঙ্গে বিতর্কে (বাহাস) অবতীর্ণ হতেন এবং তাঁদের মতবাদই যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ কর্তৃক স্বীকৃত মতবাদ তার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করতেন। আঞ্জুমান মাইজভান্ডারি তরিকার পীরদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মাইজভান্ডার (চট্টগ্রাম), সুরেশ্বর এবং বাংলার অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত উরস ও মেলায় উচ্চস্বরে জিকির এবং নাচ-গানের মতো কার্যকলাপেরও প্রবল বিরোধিতা করত। আঞ্জুমান ঘোষণা করে যে, এরূপ কার্যকলাপ কেবল অনৈসলামিকই নয়, শিরক ও বিদাতও বটে।
আঞ্জুমান-ই-ওয়াজিন-ই-বাংলা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। খিলাফত আন্দোলনের পক্ষে বাঙালি মুসলমানদের জনমত গড়ে তোলার জন্য আঞ্জুমানের নেতৃবর্গ এবং প্রচারকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চলে বহু সভা ও মিছিল সংগঠিত করেন। কিন্তু আঞ্জুমান কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি ও কংগ্রেস কর্তৃক নির্ধারিত কতিপয় নীতিমালা ও আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। আঞ্জুমান হরতাল কর্মসূচি, বিদেশি বস্ত্র পোড়ানো এবং হিন্দু-মুসলিম কি জয়, মহাত্মা গান্ধী কি জয় এ ধরনের সমকালীন জনপ্রিয় শ্লোগানগুলির তীব্র বিরোধিতা করে। তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, শরিয়তের বিধানে এতদ্সংক্রান্ত কোনো অনুমোদন নেই। অবশ্য আঞ্জুমান বেঙ্গল প্যাক্টকে (১৯২৩) সমর্থন করে। সাইমন কমিশন (১৯২৮) বয়কট এবং আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০) ও এর কর্মসূচির বিরোধিতাও করে আঞ্জুমান। ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে আঞ্জুমান ও এর নেতৃবৃন্দ কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দানের জন্য মুসলমানদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তৎকালীন আঞ্জুমানের সভাপতি মওলানা আবু বকর সিদ্দিক মুসলিম লীগের প্রার্থীদের অনুকূলে ভোট দানের জন্য মুসলমানদের প্রতি ফতোয়া জারি করেন। পরবর্তীকালে আঞ্জুমান ও এর অনুসারীরা কাজ করেন পাকিস্তান আন্দোলনের (১৯৪০-৪৭) পক্ষে। মওলানা আবুবকর সিদ্দিকের পুত্র মওলানা আব্দুল হাই এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৯ সালে মওলানা আবু বকর সিদ্দিকের মৃত্যুর পর আঞ্জুমান নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আঞ্জুমান-ই-ওয়াজিন-ই-বাংলার অধিকাংশ নেতা ও সক্রিয় কর্মী জামিয়াত-ই-উলামা-ই-বাংলা ও আসাম এবং জামিয়াত-ই-উলামা-ই-ইসলাম-এর ন্যায় উলামা সমিতিগুলিতে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে আদৌ আঞ্জুমানের কার্যক্রম চালু ছিল কিনা তা জানা যায় না। [সুনীল কান্তি দে]