লোকাচার
লোকাচার বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শাস্ত্রানুমোদিত ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি লোকাচার বা লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানেরও প্রচলন আছে। বিশেষত লোকসমাজে আচার-অনুষ্ঠানাদির অন্ত নেই। ‘বার মাসে তের পার্বণ’ কথার কথা মাত্র, প্রকৃতপক্ষে এরূপ আচার-পার্বণের সংখ্যা অজস্র। আচারগুলো প্রধানত তিথি, মাস ও ঋতু ভিত্তিক। আচারের মূলে আছে প্রধানত অন্ধ ও অলৌকিক বিশ্বাস ও নানা সংস্কার; এরূপ বিশ্বাস-সংস্কারের অনুকূলে কতক কৃত্যানুষ্ঠান সংযুক্ত করে ধর্মীয় আচারে পরিণত করা হয়। এ ভূখন্ডের প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের জাতিগোষ্ঠীর লৌকিক ও অলৌকিক বিশ্বাস-সংস্কার, ধ্যান-ধারণাকে আশ্রয় করে নানা প্রথা-পার্বণ, আচার-উৎসব গড়ে উঠেছে। আচারগুলোর উপলক্ষ, আয়োজন, উপাদান, কৃত্যানুষ্ঠান বিশেষণ করলে আদিবাসীর সংস্কার-বিশ্বাসের সঙ্গে বেশ মিল পরিলক্ষিত হয়। মানবজীবন নানা আশঙ্কা ও ভীতি, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, কল্যাণ ও মঙ্গলচিন্তা ইত্যাদি অভিব্যক্তির মধ্যে আবর্তিত হয়। এর সঙ্গে রয়েছে মানুষের সঙ্গে দৈবশক্তির সহাবস্থান। দৈবিক, ভৌতিক, অলৌকিক, নৈসর্গিক শক্তিসমূহকে সমীহ ও তুষ্ট করতে না পারলে যেমন মনে শান্তি পাওয়া যায় না, তেমনি তাদের ক্রোধ থেকেও নিস্তার পাওয়া যায় না। সুতরাং মানুষের দৈবিক বিশ্বাস ও বৈষয়িক মঙ্গলচিন্তা থেকেই লোকায়ত সমাজে নানান আচার ও ক্রিয়ানুষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। শাস্ত্রীয় আচারে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় প্রকার কামনা প্রকাশিত হলেও লোকাচারে কেবল পার্থিব কামনা-বাসনাই প্রতিফলিত হয়। লোকাচার প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণই অধিক। কোনো কোনো আচার ও ক্রিয়ানুষ্ঠানে পুরুষের অংশগ্রহণ দূরের কথা, উপস্থিতি পর্যন্ত নিষিদ্ধ। আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলিক উভয় প্রকার লোকাচার আছে। নতুন ধান ঘরে এলে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের ধূম পড়ে যায়-এটি সর্বাঞ্চলিক আচার-উৎসব। বৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘হুদমা দেওয়া’ ক্রিয়ানুষ্ঠানটি কেবল রংপুরের কোচ-রমণীদের মধ্যে প্রচলিত আছে, যা আঞ্চলিক। লোকাচারগুলোতে জাতির অতীত ইতিহাস, বিচিত্র সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রচলিত লোকাচার ও প্রথাসমূহকে ১. মানব, ২. পশু ও ৩. কৃষি- এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।
মানব জীবন প্রবাহের প্রতিটি স্তরে বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট ও শোক-তাপের আশঙ্কা থাকে। বিপদমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ জীবনের কামনা-বাসনা থেকে মানুষ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন আচার-প্রথা গড়ে তুলেছে। বাংলার লোকাচারগুলো প্রধানত শিশুজন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু-এই তিনটি স্তরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। মানুষমাত্রই সন্তান কামনা করে। মূলত বংশরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য সন্তান একান্ত কাম্য। এ উদ্দেশ্যে সন্তানের স্বাভাবিক জন্ম, নির্বিঘ্ন বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ মঙ্গলচিন্তা আচারগুলোর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। অধিকাংশ আচারে দৈবিক শক্তির প্রভাব আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে নারীর দুর্বল মনস্তত্ত্বের ফলস্বরূপ শিশুজন্ম-বিষয়ক আচারগুলো গড়ে উঠেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় এগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ১. গর্ভপূর্ব-অবস্থা ২. গর্ভকালীন-অবস্থা এবং ৩. গর্ভোত্তর-অবস্থা।
বিবাহ ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী ইজাব কবুল, খোতবা ও কাবিননামা সম্পাদন করে আর হিন্দুশাস্ত্র মতে মন্ত্রপাঠ, সম্প্রদান, মালাবদল ইত্যাদি সম্পন্ন হলে নরনারীর দাম্পত্য জীবনের অধিকার জন্মে। এর বাইরের সব আনুষ্ঠানিকতাই লোকাচার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকাচার শাস্ত্রাচার থেকে প্রবল বলে বিবেচিত হয়ে থাকে যা পালন না করলে অনেকের কাছে বিবাহপর্ব পূর্ণাঙ্গ হয় না। মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহাচারের বিচিত্রতা রয়েছে। এগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়। ঘটকের মাধ্যমে বর ও কনে নির্বাচন থেকে শুরু করে কনের নাইয়র শেষে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত বাংলার গৃহস্থ পরিবারে যেসব আচার-প্রথার প্রচলন আছে, সেগুলোকে সময়ের ধারাবাহিকতায় নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যায়:
বিবাহপূর্ব পানচিনি, আশীর্বাদ, ঢেঁকি বরণ, দিনধরা খদানি, থুবড়া খাওয়া, আইবুড়ো ভাত, হাড়িয়া উৎসর্গ, গায়ে-হলুদ, মেহেদি তোলা, ক্ষীর চাকানো, খাত্তা ভাঙ্গানো, বর/কনে স্নান, কলাই মঙ্গলা, লগন খেলা, পানি ভরণ, ফুরুল ডুবা, অধিবাস, বরসজ্জা, বরণডালা।
বিবাহকালীন মাড়োয়া সাজানো, বরবরণ, হাংগোড় ধরা, কলেমা/মন্ত্রপাঠ, ইজাব কবুল, মন্ডপ প্রদক্ষিণ, কনে সিংরানো, গাঁটছড়া বাঁধা, শুভদৃষ্টি/শা’নজর, মালাবদল, সিঁদুর দান, পাঁচ গেলাসী, কন্যা বিদায়।
বিবাহোত্তর বধূবরণ, কড়িখেলা, পাশাখেলা, বাসরঘর-কঞ্চন, বাসরজাগা, ফুলসজ্জা, বাসি-গোসল, খোলাভাঙ্গা, ধানঝাড়া, বৌভাত, বৌনাচানো, বৌফিরানি, অষ্টমঙ্গলা, ভাদর-কাটানি।
বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান পালনে বিধিনিষেধের বাছবিচার করা হয়। এ সবের মধ্যে নানা সংস্কার, ট্যাবু, জাদুবিশ্বাস ও দৈবশক্তির প্রভাব আছে। বিধবা রমণীকে বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপয়া গণ্য করা হয়। এয়ো রমণীরাই সকল আচার পরিচালনা করে থাকে। লাল রং, সবুজ চুড়ি ও সাদা শাঁখাকে সৌভাগ্যের চিহ্ন বিবেচনা করা হয়। বরণডালায় লাল শাড়ি ও লাল ফিতা আবশ্যকীয় সামগ্রী। কিছু দ্রব্যের নৃতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনা আছে; যেমন হলুদ রং সৌন্দর্যবর্ধক ও অশুভ শক্তির প্রতিষেধক, সিঁদুর ও আলতা রক্ত বা রজঃর প্রতীক, আংটি, কড়ি, কলা নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের প্রতীক, জলপূর্ণঘট ও ডাব অন্তঃসত্ত্বা রমণীর প্রতীক, মাছ, কলাগাছ ও দূর্বা বহুপ্রজ বিধায় প্রজননের প্রতীক।
ব্যাধি দেহে রোগ-ব্যাধির অন্যতম কারণ নানারূপ জীবাণু- এই বৈজ্ঞানিক সত্য জানা থাকলেও রোগের পিছনে এক একটি দৈবশক্তির প্রভাবকে অনেকে বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। কলেরার দেবী ওলাদেবী বা ওলাবিবি, বসন্তের দেবী শীতলা, খোস-পাঁচড়ার অপদেবতা ঘেঁটু। এদের পূজা-মানত করলে ওইসব রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই দেবতাকে সন্তুষ্ট করে নিরাপদ জীবন লাভের জন্য তাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। ওলাদেবীকে ওলাবিবি, বনদুর্গাকে বনবিবি, দক্ষিণ রায়কে গাজীপীর রূপান্তর মুসলমানদেরই কল্পনাপ্রসূত। এরূপ বিশ্বাস-সংস্কারের ভিত্তিমূল এতই দৃঢ় যে, আধুনিক চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রচলন হলেও গ্রামজীবন থেকে তা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি, কোনো কোনো অঞ্চলে পুরাপুরি বিদ্যমান আছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে নানান ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ও গাছ-গাছড়ার চিকিৎসা। দক্ষিণবঙ্গের বাওয়ালি, কাঠুরিয়া, মউলে, জেলে প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষ সুন্দরবনে প্রবেশ করার আগে কোথাও গাজীপীরের, কোথাও বনবিবির মানত-শিরনি পালন করে থাকে। গাজীপীর বাঘের দেবতা, বনবিবি বনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; তাঁদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ করলে, মানত করলে এবং শিরনি দিলে, হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। প্রাণের বদলে প্রাণ-এরূপ চেতনা থেকে বনবিবির উদ্দেশ্যে জীবন্ত ‘মোরগ’ উৎসর্গের রীতি আছে। এটি কেউ হত্যা করে না।
মৃত্যু মৃত ব্যক্তির সৎকার এবং মৃত আত্মার শান্তি কামনায় নানা আচার প্রচলিত আছে। ইসলামশাস্ত্রে জন্মান্তরবাদের স্থান নেই, তবে মৃত্যুর পর কেয়ামতের দিন মানুষ পুনর্জীবন লাভ করবে এবং কর্মফল অনুযায়ী দোজখ বা বেহেশ্তবাসী হবে, এরূপ বিশ্বাস আছে। খ্রিস্টধর্মেও অনুরূপ বিধান আছে। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মৃতদেহ কবরস্থ করা হয়। হিন্দুশাস্ত্র মতে, মানুষ বারবার পুনর্জন্ম লাভ করে এবং কর্মফল অনুযায়ী দুঃখ-কষ্ট বা সুখ-শান্তি ভোগ করে। হিন্দুদের মৃতদেহ দাহ করা হয়। সর্বপ্রাণবাদী আদিবাসীর ধারণা, মৃত্যু জীবনের শেষ পরিণতি নয়। তারা পূর্বপুরুষের পূজা করে এবং তাদের আত্মাকে সন্তুষ্ট রাখতে নানা আচার পালন করে। অনেক আদিবাসীর বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির দেহের হাড়-পোড়ানো ছাই জমিতে ছিটিয়ে দিলে জমির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পায়।
কৃষি ও ফসল বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হওয়ায় এদেশের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবন কৃষিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বহু প্রাচীনকাল থেকে কৃষিকাজ চলে আসছে। সেযুগে সেচ, সার, বাঁধ, কীটনাশক ঔষধ ইত্যাদির ব্যবহার ছিল না। প্রকৃতি ও দৈবের ওপর নির্ভর করে থাকা বা প্রতিকারের আশায় তাদের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। এদেশের ঊর্বর মাটি কৃষিকাজের বিশেষ উপযোগী এবং আবহাওয়াও কৃষিকাজের অনুকূল। তবে কখনো কখনো অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, কীটপতঙ্গ কৃষকের চাষাবাদ ও ফসলের ক্ষতি করে। সঙ্গতকারণেই মানুষ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে প্রচলিত কৃষি-সংক্রান্ত আচারগুলোকে কালানুক্রমিক ১. বৃষ্টিআবাহন, ২. বৃষ্টিবারণ, ৩. জমিচাষ, ৪. বীজবপন, ৫. ফসলরক্ষা, ৬. ফসলতোলা এরূপে বিন্যাস করা যায়। দেশের নানা অঞ্চলে প্রচলিত বৃষ্টির মাগন, হুদমা দেও, মেঘারানী, জলমঙ্গলা, ব্যাঙবিয়া, পুতলবিয়া, ডাকলক্ষ্মী, নবান্নউৎসব ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান চাষাবাদ ও ফসলকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। এসব আচারের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় জাতির বহু নৃতাত্ত্বিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। [ওয়াকিল আহমদ]