শান্তি বাহিনী
শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন। ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন হিসেবে শান্তিবাহিনীর উদ্ভবের পটভূমি রচিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে চাকমা জাতি দশ বছরব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। ব্রিটিশরাজ্যের একটি স্বশাসিত এলাকারূপে পার্বত্য চট্রগ্রামের স্বীকৃতি লাভ ছিল ওই আন্দোলনের লক্ষ্য। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। এরই ফলে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। ওই অধ্যাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ওই অসন্তোষেরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির। এর আশু কারণ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উদ্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা নিজেদের জুমিয়া জাতি হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে এর স্বীকৃতি দাবি করে। স্বীকৃতিলাভে ব্যর্থ হয়ে জুমিয়া জাতি আত্মনিয়নের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত ৪ দফা দাবিনামা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট পেশ করে: (ক) নিজস্ব আইন পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা; (খ) ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশের অনুরূপ সংবিধি বাংলাদেশের সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা; (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করা; এবং (ঘ) সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সংরক্ষিত রাখার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।
এই দাবিসমূহের আলোকে ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা লিখিতভাবে সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার দাবি জানান। কিন্তু নতুন সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মর্যাদা দেয় নি। এরূপে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।
কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে শান্তিবাহিনী তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। প্রতিটি অঞ্চলকে আবার ৩টি সেক্টরে এবং সেক্টরগুলোকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করা হয়। জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম অরণ্যে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ বিপুল সংখ্যক পাহাড়িদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শান্তিবাহিনীভুক্ত করা হয়। নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয়। শান্তিবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীকে সহায়তার লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এবং বহুসংখ্যক যুব সমিতি ও মহিলা সমিতি গড়ে তোলা হয়। সামগ্রিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ শেষে শান্তিবাহিনী ১৯৭৬ সালের প্রথমদিকে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। শান্তিবাহিনী পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিদের আক্রমণ ও হত্যা, নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ, তাদের মতাদর্শ বিরোধী উপজাতীয়দের হত্যা, সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন, অপহরণ ও বলপূর্বক চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জোরদার করে। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর অন্তর্দলীয় কোন্দলে নিহত হবার পূর্ব পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
মানবেন্দ্র লারমার হত্যাকান্ডের পর শান্তিবাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে (লারমা ও প্রীতি গ্রুপ) আত্মঘাতি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিয়ে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এবং তাদের প্রতি অস্ত্র সমর্পণ ও বিদ্রোহ সংঘাত বন্ধ করার আহবান জানায়। প্রীতি গ্রুপের অধিকাংশ নেতা-কর্মী ১৯৮৫ সালের ২৯ এপ্রিল আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু লারমা গ্রুপ নাশকতামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার বোধিপ্রিয় লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন (১৯৮৫)। এরপর বিভিন্ন সময়ে সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত সরকার পূর্ববর্তী সকল সরকারের নেয়া শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। অবশেষে পরবর্তী মেয়াদের (১৯৯৬-৯৭) জন্য নির্ধারিত সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯৯ সালে জনসংহতি সমিতির ষষ্ঠ মহাসম্মেলনে শান্তিবাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। [রোজিনা কাদের]