সিপাহি বিপ্লব, ১৮৫৭
সিপাহি বিপ্লব, ১৮৫৭ মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে শুরু হয় এবং শীঘ্রই তা মিরাট, দিলি এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খন্ডযুদ্ধসমূহ বাংলাদেশকে সর্তক ও উত্তেজনাকর করে তুলেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা হতে সকল বন্দিদের মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে নেয়, কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।
চট্টগ্রামে সিপাহিদের মনোভাব ঢাকার রক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সিপাহিদের আরও অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং একশত নৌসেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সাথে যশোর, রংপুর, দিনাজপুর এবং বাংলাদেশের আরও কয়েকটি জেলায় একটি নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানত ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে ওঠে। ২২ নভেম্বর লালবাগে নিয়োজিত সিপাহিগণকে নিরস্ত্র করতে গেলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খন্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহি নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়। অধিকাংশ পলাতক সিপাহিই গ্রেপ্তার হয় এবং অতিদ্রুত গঠিত সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য তাদের সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্ত সিপাহিদের মধ্যে ১১ জন মৃত্যুদন্ড এবং বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়। এ রায় দ্রুত কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং যশোরে চাপা ও প্রকাশ্য উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে সিলেট এবং অপরাপর স্থানে কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সিলেট এবং যশোরে বন্দি ও নিরস্ত্র সিপাহিদের স্থানীয় বিচারকদের দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচার করা হয়। ফাঁসি ও নির্বাসন ছিল এ সংক্ষিপ্ত বিচারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
সিপাহি যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া একটি অনুজ্জ্বল চিত্র প্রতিফলিত করে। জমিদার-জোতদারগণ নিশ্চিতভাবে সিপাহিদের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ গরু ও ঘোড়ারগাড়ি এবং হাতি সরবরাহ; পলায়নরত সিপাহিদের গতিবিধির সন্ধান প্রদান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচছাসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কৌশলগত সমর্থন প্রদান করেন। সরকার কৃতজ্ঞতার সাথে জমিদার-জোতদারগণের এ সকল সেবার স্বীকৃতি প্রদান করে এবং পরে তাঁদেরকে নওয়াব, খান বাহাদুর, খান সাহেব, রায় বাহাদুর, রায় সাহেব প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করে এবং নানা পার্থিব সম্পদ দ্বারা পুরস্কৃত করে। জমিদার-জোতদারগণের প্রদর্শিত ভূমিকা অনুসরণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কোম্পানির সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ ও কৃষককুল সার্বিকভাবে এ বিষয়ে উদাসীন ছিল এবং সিপাহি যুদ্ধের স্পর্শ থেকে দূরে ছিল। তবে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। [রতনলাল চক্রবর্তী]
গ্রন্থপঞ্জি RC Majumdar, The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857, Calcutta, 1963; Ratan Lal Chakraborty, Sipahi Yuddha O Bangladesh (in Bangla), Dhaka, 1984.