হেস্টিংস, লর্ড
হেস্টিংস, লর্ড (১৭৫৪-১৮২৬) ১৮১৩ থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল। ফ্রান্সিস রাওডন হেস্টিংস ১৭৫৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং হ্যারো ও অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৭৭১ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন, আমেরিকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, ১৭৭৮ সালে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং পরে ময়রার আর্ল হিসেবে তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮১৩ সালে ষাট বছর বয়সে তিনি গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন এবং ১৮২৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষও ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, একজন সামান্য সৈনিক হয়ে উঠেন রণকৌশলবিদ, একজন প্রাক্তন রাজসভাসদ পরিণত হন রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ ব্যক্তিত্বে, একজন জুয়ারি হন কোম্পানির কর্মকর্তাদের সতর্ক তত্ত্বাবধায়ক এবং একজন কেতাদুরস্ত ব্যক্তি হয়েও তিনি জনগণের মঙ্গলসাধনে ছিলেন উদ্বিগ্ন।
ভারতীয় শক্তির রাজনীতিতে অংশ নিতে তিনি কার্যত বাধ্য হন এবং ওয়েলেসলী যে কাজ শুরু করেছিলেন তা সমাপ্ত করেন। ভারতে পৌঁছার পর হেস্টিংস অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, তাঁর পূর্বসূরিগণ বেশ কিছু বিবাদমান পরিস্থিতি রেখে গেছেন যার প্রত্যেকটি সামলাতে অস্ত্রের সাহায্য নেওয়া দরকার। এর মধ্যে মারাত্মক দুটি ছিল গুর্খা অভ্যুত্থান এবং পিন্ডারীদের ভীতি। তাঁর আগমনের কিছুকাল পরেই তাঁকে গুর্খাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে, যারা উত্তরাঞ্চলের গঙ্গা সমভূমিতে হানা দেওয়া শুরু করে। তারা দুবছর যাবৎ যুদ্ধ চালিয়ে যায়, কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যদলের বিরুদ্ধে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। অবশেষে তারা ১৮১৬ সালের মার্চে সাগাউলি চুক্তি মেনে নেয়। এ চুক্তি অনুযায়ী নেপালিরা কুমায়ন ও গাহরওয়াল এবং সিমলার শৈলাবাস ও এর আশপাশের এলাকাসমূহ ব্রিটিশদের নিকট সমর্পণ করে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে, যা ভারতে ব্রিটিশদের শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল। লর্ড হেস্টিংস এরপর মধ্য ভারতে পিন্ডারীদের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং কয়েকটি যুদ্ধের পর তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। পিন্ডারীদের বিশিষ্ট নেতা আমীর খান টঙ্ক-এর নওয়াব হন এবং আরও অনেক নেতা বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
পিন্ডারীদের দমন করার পর হেস্টিংস মারাঠাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। মারাঠারা তাদের স্বাধীন অবস্থা ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ বাহিনী একের পর এক পেশোয়া, নাগপুরের শাসকবৃন্দ ও ইন্দোরের রাজাকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে এবং মারাঠাদের অধীনতামূলক মিত্রতা মেনে নিতে হয়। এভাবে শতদ্রু ও সিন্ধু নদের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র ভারতব্যাপী ব্রিটিশদের ক্ষমতা সুদৃঢ়করণ সম্পূর্ণ হয়। ১৮১৯ সালে হেস্টিংস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সিংগাপুর দ্বীপ অধিকার করেন। লর্ড হেস্টিংস খেতাব সর্বস্ব মুগল সম্রাটকে আনুষ্ঠানিক উপহারাদি পাঠানোও বন্ধ করে দেন। এর দ্বারা ভারতে ব্রিটিশদের একাধিপত্যের প্রকাশ ঘটে।
যদিও হেস্টিংস ভারতে তাঁর শাসনামলে অধিকাংশ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহে নিয়োজিত ছিলেন, তবুও তিনি বেসামরিক বিষয়াবলির প্রতিও দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তিনি যে সকল জনকল্যাণমূলক কাজে হাত দিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাস্তা ও সেতু নির্মাণ এবং খাল খনন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে ভারতীয়দের উৎসাহিত করেন, ১৮১৬ সালে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের ছাপাখানা ও শ্রীরামপুরে একটি কলেজ স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি বিচারালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং ভারতীয় বিচারক নিয়োগকে অনুপ্রাণিত করেন। লর্ড হেস্টিংস ১৮২৩ সালে পদত্যাগ করেন এবং ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮২৬ সালে তাঁর মৃতুৃ্য হয়। [কে.এম মোহসীন]