হাওলাদার, আবদুর রহমান
হাওলাদার, আবদুর রহমান (১৯০১-১৯৭৪) ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবক। তিনি ১৯০১ সালে মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী ছবরউদ্দীন এবং মাতা হাজী মাজেদা খাতুন।
আবদুর রহমান হাওলাদারের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়নি। তিনি ১৯২৭ সালে একজন সাধারণ পাটের ফড়িয়া হিসেবে তার ব্যবসা শুরু করেন। সে সময় মুসলিমদের মধ্যে বড় পাটের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। পাটের ব্যবসা তখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতেন মাড়োয়ারী, বিত্তবান হিন্দুরা এবং ইংরেজরা। অল্পদিনের মধ্যেই আবদুর রহমান হাওলাদার নিজ বুদ্ধি, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, অধ্যাবসায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পাট ব্যবসায় সাফল্য লাভ করে হয়ে উঠেন একজন বড় পাট ব্যবসায়ী। এরপর তিনি কলকাতার বাজারে নিজস্ব মার্কায় পাট বিক্রি শুরু করেন। তিনি ১৯৪২ সাল থেকে সুতা, চাল, কাপড় প্রভৃতি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। ভারত বিভাগের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবির্ভাব হলে তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে পাট বিক্রি করার জন্য পাট রপ্তানিকারক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৫৮ সালে আবদুর রহমান হাওলাদার পপুলার ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি নামে লঞ্চ সার্ভিস চালু করেন। আবদুর রহমান হাওলাদার একজন সচেতনকর্মী ছিলেন। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কথা ভাবতেন। এ চিন্তা থেকেই তিনি বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য মাদারীপুরে একটি জুট মিল স্থাপন করতে সচেষ্ট হন। এভাবেই তিনি ১৯৬৬ সালে ইপি আইডিসির সহায়তায় চরমুগুরিয়ার আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে ৪৩ একর জমির উপর ‘এ আর খান জুট মিলস’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এ জুটমিলে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। এতে তাদের জীবন পদ্ধতি পাল্টে যায় এবং সমাজের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। এ আর হাওলাদার জুটমিলস স্থাপিত হওয়ায় মাদারীপুর শহরেও যথেষ্ট উন্নতি হয়। তাই বলা যায় যে, এ.আর. হাওলাদার জুট মিলস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবদুর রহমান হাওলাদার বেকার সমস্যা সমাধানে এবং শহর উন্নয়নে যে অবদান রেখে গেছেন তা সবার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আবদুর রহমান হাওলাদার একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মাদারীপুরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছেন যাতে সমাজের সকল মানুষই শিক্ষার আলো পায়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নাজিমউদ্দিন কলেজ স্থাপনেও তার যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন ক্লাব সংস্থার উন্নয়নে অকাতরে সাহায্য সহযোগিতা করতেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই মুসলিম লীগএর সঙ্গে সংশিষ্ট এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই সংযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু তিনি গণহত্যায় অংশ নেননি। বলা হয় যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করতেন।
আবদুর রহমান হাওলাদার একজন গুণগ্রাহী ব্যক্তি ছিলেন। কেবল সততা, আন্তরিকতা ও কল্যাণ-চেতনার জন্য সকল সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ছিলেন একজন পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। বস্ত্তত তিনি ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা, হিন্দু ও মুসলিম-সকলেরই অভিভাবক।
আবদুর রহমান হাওলাদার অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পোদ্যোগীর জীবন কাহিনী’ গ্রন্থে তার গুণাবলি এবং প্রতিভার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [এ.বি.এম. শামসুদ্দীন আহমদ]