শিশুপ্রসব আচার
শিশুপ্রসব আচার বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বহু আচার-অনুষ্ঠানসহ বংশ পরম্পরাগত বিধিনিষেধ ও সনাতনী ভেষজভিত্তিক প্রতিকার ব্যবস্থা, এ দুয়ের সমন্বয়ে গঠিত। বর্তমান যুগেও গর্ভাবস্থায় বা প্রসবকালে কোন জটিলতা দেখা দিলে তা অলৌকিক কারণসমূহের দরুন কিংবা, কুসংস্কার-ভিত্তিক বিশেষ আচার আচরণের দরুন সংঘটিত বলে মনে করা হয়। এসব জটিলতা মোকাবেলা করার জন্য অলৌকিক সাহায্যপ্রাপ্তির চেষ্টা করা হয়। এসব প্রতিকার ব্যবস্থার উৎস বৈদিক যুগে, অর্থাৎ, খ্রিস্টপুর্ব ১৫০০-৮০০ সালে। বৈদিক যুগের ভেষজের সাথে ছিল ধর্ম, যাদু বিদ্যা ও সম্মোহনের সংমিশ্রণ। অথর্ববেদ থেকে জানা যায়, বৈদিক যুগে উদ্ভিদ-উপাদানসমূহের সাথে মন্ত্রেরও সমন্বয় করা হতো। এভাবে আয়ুর্বেদীয় ভেষজ পদ্ধতি উদ্ভবের পথ সুগম হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের কাছাকাছি সমন্বয় আয়ুর্বেদীয় যুগের প্রারম্ভ। আয়ুর্বেদীয় মতে, মানবদেহের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন তিনটি প্রধান মৌলিক উপাদান বায়ু, পিত্ত ও শ্লেষ্মার সুষম সংমিশ্রণ। যথাযথ খাদ্য গ্রহণে এরূপ সুষম সংমিশ্রণ সম্ভব। খাদ্যসমূহ ঝাল ও পানসে দুটো প্রধান ভাগে বিভক্ত। গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তর অবস্থাকে দেহের অস্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় যে কারণে ভারসাম্য ব্যাহত হতে পারে। সুষম খাদ্য গ্রহণে তা এড়ানো সম্ভব।
চরকসংহিতা (২০০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে প্রসব সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের ইতিবৃত্ত জানা যায়। তৎকালে কিছু উদ্ভিদ উপকরণ, মশলা, ঘি, ধাতু এবং মন্ত্রপূত কবচের ব্যবহার, আগুন জ্বালানো ও খাদ্য সম্পর্কিত বাছবিচার ইত্যাদি ছিল প্রসবপদ্ধতির এক অবিচ্ছিন্ন দৃশ্যপট। দোয়া পড়া তাবিজের (মন্ত্রপূত কবচ) ব্যবহার, আগুন জ্বালানো, খাদ্যের বাছবিচার ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাবলম্বন পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যেও সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। পূতকরণের আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া হিন্দু ও মুসলমানের শিশুপ্রসব পদ্ধতিতে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না।
অন্তঃসত্ত্বাবস্থাকে মাতা ও ভ্রূণ, উভয়ের জন্যই সঙ্কটসঙ্কুল বলে মনে করা হয়। একজন গর্ভবতী মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বাবস্থায় কিছু বাধানিষেধ মেনে চলতে হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ভ্রূণের গঠন ও বিকাশে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিধি এবং সামাজিক আচরণের মান সংরক্ষণ বা উল্লঙ্ঘনের প্রভাব পড়ে। যেমন, চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সময় যৌনসঙ্গম, অন্তঃসত্ত্বাবস্থায় জীব হত্যা বা ফলের গাছের শাখা কর্তনের কারণে মৃত বাচ্চা বা বিকলাঙ্গ শিশু ভূমিষ্ঠ হতে পারে। একজন গর্ভবতী মহিলার ঊষা, দ্বিপ্রহর বা গোধূলি কালে ঘরের বাইরে পা বাড়ানো উচিত নয়, কারণ এসব সময়ে জিন বা ভূত বেশি সক্রিয় থাকে এবং তার ক্ষতি করতে পারে। এসব দুষ্ট আত্মার প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গর্ভবতী মহিলাদের তাবিজ ধারণ করতে হয়। একটি তাবিজে নিজস্ব ধর্মগ্রন্থের আয়াত/মন্ত্র, বিশেষ রেখাচিত্র এবং/অথবা উদ্ভিদ সামগ্রী রাখা হয়। গর্ভাবস্থায় মহিলারা খাবারের বাছ-বিচার মেনে চলে। ধারণা ছিল, রসনা-উদ্দীপক খাদ্যের প্রতি অত্যুৎসাহ শিশুকে বড় আকারে গড়ে তুলতে পারে যার দরুন মায়ের প্রসবে অসুবিধা হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় আধুনিক ঔষধপত্র এড়ানো হয়।
বাংলাদেশের পল্লীতে প্রায় সব মহিলারই বাড়িতেই প্রসব করানো হয়, বয়স্ক মহিলা বা আত্মীয়া অথবা/এবং দাই নামক ঐতিহ্যগত প্রসব তত্ত্বাবধায়িকা এতে সহায়তা করেন। মুসলমানগণ একটি আলাদা কামরা, চালাবৃত রান্নাঘর কিংবা পর্দার আবরণে ঢাকা আঙিনার একটি অংশকে প্রসব ঘর হিসেবে ব্যবহার করে। হিন্দুরা এজন্য আলাদা কামরা কিংবা আঙিনায় চালাঘর তৈরি করে। পরে এটাকে পুড়িয়ে ফেলে। একজন মুসলিম মহিলার প্রসব বিছানায় অথবা মেঝেতে পাতা বেতের মাদুরে হতে পারে, তবে একজন হিন্দু মহিলার প্রসব সর্বদা মেঝেতে খড়ের বিছানাতেই হবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই দুষ্ট আত্মাকে দূরে ঠেকিয়ে রাখার জন্য বিছানার নিচে একটি পুরানো ছুরি, একটি পুরানো জুতা এবং একটি ঝাঁটা রাখা থাকে। পবিত্রীকৃত সরষে দানা অাঁতুড় ঘরের (প্রসব কক্ষ) দোরগোড়ায় ছড়িয়ে রাখা হয়। দাই ডাকা হলে গর্ভবতী মহিলা নিরাপদ প্রসবের জন্য তার ওপর নির্ভরতার নিদর্শনস্বরূপ দোরগোড়ায় দাইয়ের পা ধুয়ে দেয়। সাধারণত শোয়া, হাঁটু গেড়ে বসা বা উবু হয়ে বসা অবস্থায় প্রসব করানো হয়। প্রসবকালে পানি, দুধ বা চা পান শিশুর উল্টোদিকের নড়া-চড়া রোধ করে। জটিলতা দেখা দিলে গর্ভবতী মহিলাকে পানি পড়া ও মক্কা থেকে আনা পানি পান করানো হয়। পানির খানিকটা ভ্রূণের নাভি ও ‘ফুলের’ (গর্ভ-পরিশ্রব) সংযোজক নালীতে ছিঁটানো হয়। প্রয়োজনবোধে কবিরাজ এবং হোমিওপ্যাথকেও ডাকা হয়। তাবিজ এবং পবিত্রীকৃত পাট অথবা হাতিশুরি গাছের ফল তার কোমরে এবং/অথবা উরুতে বাঁধা হয়। কখনও কখনও ধাত্রী শিশুকে ভূমিষ্ঠ হবার আমন্ত্রণ জ্ঞাপন উদ্দেশ্যে মায়ের প্রসব দ্বারের নিচে কুলা রাখে। নিরাপদ প্রসবের জন্য আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে পশু জবাই করার অঙ্গীকার মুসলমানদের মধ্যে একটি চলতি রেওয়াজ।
শিশু ভুমিষ্ঠ হবার পর গর্ভ-পরিশ্রবের (ফুল) নির্গত হওয়ায় যদি বিলম্ব হয়, তাহলে মাতাকে বমি করানোর চেষ্টা করা হয়। সেজন্য রসুন বাঁটা অথবা কেরোসিন তেলে ভেজানো চুলের গোছা তার গলার ভিতরে ঢোকানো হয়। ছুঁচ বা ঝাঁটার কাঠি দিয়ে রশি ছিদ্র করে, সেটিকে তলপেটে স্থাপন করে অথবা হাঁটু বা ছোট নিচু চৌকি দ্বারা চাপ সৃষ্টি করে পরিশ্রব বার করার চেষ্টা একটি প্রচলিত পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ার সময়ও কিছু আচার পালন করা হয়, যেমন তাওয়ায় ফুলের পাপড়ি সেঁকা হয়, যেসব দড়ি দিয়ে খড়ের চালা বাঁধা হয় তা কেটে ফেলা হয়, তালা খুলে ফেলা হয়, দরজার কব্জা খুলে ফেলা হয়, সঞ্চিত ধানের আবরণ তুলে নেওয়া হয়, বাঁশের গাঁইট ছেঁটে ফেলা হয়। পরিশ্রব বার করে দেওয়ার পর ‘ফুল’-সংযোজক নাড়ির দুটো জায়গা এক টুকরো সুতা অথবা ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। নাড়ির বাঁধা দুটো জায়গার মধ্যস্থল রৌপ্যতুল্য (চকচকে) বাঁশের বাকলের ধারালো টুকরা (অথবা কদাচিৎ ব্লেড) দিয়ে কাটা হয় এবং ক্ষতস্থানে ছাই বা পোড়ামাটির প্রলেপ দিয়ে পট্টি বাঁধা হয়। পরিশ্রবকে কলাপাতা বা মাটির পাত্রে রেখে মাটিতে এমন গভীরে পুঁতে ফেলা হয় যাতে তা জীবজন্তু বা দুষ্ট আত্মার নাগালের বাইরে থাকতে পারে। এই পরিশ্রবে কারও ছোঁয়া লাগলে মায়ের দুধ শুকিয়ে যেতে পারে যে কারণে নবজাত শিশুর উদরাময়, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে বলে ভাবা হয়। কোন পচা মাংসাশী জীবজন্তু যেন পুঁতে-ফেলা পরিশ্রব বার করে না আনতে পারে, সেজন্য অনেকে তা ধাতুপাত্রের আবরণেও পুঁতে রাখে।
শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই তার নাকের দুটো ফুটাতে ও দুকানে কয়েক ফোঁটা সরষের তেল ঢোকানো হয়, এবং তাকে খাবার হিসেবে নয় আর্দ্র করার জন্য জিভেও সামান্য তেল দেওয়া হয়। শিশুর প্রথম খাদ্য মধু। প্রায় সবক্ষেত্রেই শিশুকে ‘কোলাস্ট্রাম’ (মায়ের দুধের আদি অবস্থা) দেওয়া হয় না, কারণ তা অপরিচ্ছন্ন বা অতি ঘন ও হজমের পক্ষে গুরুপাক বলে বিবেচিত। শিশুকে স্নান করানোর পর তার কানে, ছেলের ক্ষেত্রে ডান কানে ও মেয়ের ক্ষেত্রে বাঁ কানে, মৃদুস্বরে আযানের ধ্বনি শোনানো হয়। হিন্দু ঘরে ছেলে জন্মালে বাজনা বা কাঠি দিয়ে কাঁসার ঘণ্টা বাজানো হয়। কুদৃষ্টি এড়ানোর জন্য বাচ্চার কপালের একদিকে একটি কালো ফোঁটা দেওয়া হয় ও কোমরে কাল সুতা জড়ানো হয়, এবং অশুভ কিছু এড়ানোর জন্য একটি তাবিজ দেওয়া হয়। শিশুর জন্মের পরপরই আগুন জ্বালিয়ে রাখলে তা মন্দ আত্মাকে দূরে রাখতে পারে। আগুনের পাত্রটি দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গ সেঁকার কাজেও আসে। এই উত্তাপ জরায়ুকে গুটিয়ে আনতে এবং জঠরের আহত স্থানকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। তাপ প্রয়োগের কয়েকটি পদ্ধতি আছে, যেমন আগুন গোলার মতো শুকনা মাটির দলাকে কাপড়ে জড়িয়ে তলপেটে হাল্কাভাবে চেপে ধরা হয়, অথবা মেঝেতে গর্ত করে তাতে বারো ধরনের মশলা পুরে আগুন জ্বালানো হয়। যখন ধোঁয়া বেরুতে থাকে তখন গর্তটির ওপর মহিলা উবু হয়ে বসে। কখনও কখনও তাকে গরম ইটের উপরও বসানো হয়।
হিন্দু ও মুসলিম উভয়ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠ রাত্রি তাৎপর্যপূর্ণ। হিন্দুদের নিকট ষষ্ঠ দিবসটি সরস্বতী দিন। তাদের বিশ্বাস ওই রাতে ভগবান শিশুর ভাগ্য নিরূপণ ও লিপিবদ্ধ করেন। একটি কুলায় এক টুকরো কাগজ, কালি, কলম, সোনা, রুপা ও দস্তামিশ্রিত ধাতুতে তৈরি একটি আঙটি, ধান, খোসাবিহীন চাল, দুধ, ঘাস, জবা ফুল, ঘি, মধু, আমের শাখা, প্রভৃতি রাখা হয়। মুসলমানদের কাছে এ রাতটি অশুভ মনে করা হয়, কারণ মন্দ আত্মারা মায়ের কাছ থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নেবার জন্য অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যান্য আত্মীয়াসহ মা সারারাত জেগে থাকে এবং শিশুকে তাদের কোলে কোলে রাখে। হিন্দু এবং মুসলমানগণ উভয় ধর্মের পরিবারই সাতদিন পর্যন্ত সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখে।
জন্মের সপ্তম, চতুর্দশতম বা একবিংশতম দিবসে নামকরণ করার অনুষ্ঠান আকিকা পালন করা হয়। বালক শিশুর জন্য দুটি এবং শিশু কন্যার জন্য একটি ছাগল আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে জবাই করা হয়। হিন্দুদের বেলায় দশম দিবসে নামকরণ অনুষ্ঠান ও তারপর পূজাপর্ব হয়। শিশুর দুটি নাম রাখা হয়, একটি জন্মলগ্নে নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে, অন্যটি সবসময় ব্যবহারের জন্য। মুসলমানদের বেলায় সপ্তম দিবসে বাচ্চার চুল কামানো হয়। চুলের ওজনের সমান ওজনের সোনা বা রুপার মূল্য হিসেবে যত টাকা আসে সেই পরিমাণ অর্থ গরিবদের দান করা হয়। কামিয়ে ফেলা চুল মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় কিংবা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। হিন্দুদের বেলায় চুল কামানো হয় দুবার, প্রথমবার পঞ্চম সপ্তম অথবা নবম দিবসে এবং শেষবার ত্রিশতম দিবসে।
কলুষতা দূরীকরণের জন্য হিন্দুরা দাই ও নাপিতের ওপর নির্ভর করে। হিন্দু ও মুসলমান উভয়ক্ষেত্রেই শিশুর জন্মকে কলুষিত ভাবা হয়। কতগুলি দিন কলুষিত তা বিভিন্ন ধর্মে, এমনকি বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীতে বিভিন্নভাবে ধরা হয়। তা ১১ দিন (ব্রাহ্মণদের বেলায়) থেকে ৩০ দিন (শূদ্রদের বেলায়)। একজন মুসলমান মহিলাকে অপবিত্র ধরা হয় যতক্ষণ তার প্রসবোত্তর রক্তস্রাব চলতে থাকে (সাধারণত প্রসবের ৪০ দিন পর্যন্ত)। প্রসবকারী মহিলার যে ধর্মেরই হোক, অপবিত্র অবস্থায়, ধর্মকর্ম পালনে বা রতি ক্রিয়ায় নিষেধ আছে। তাকে গরুর দুধ দোওয়ানো, হাঁসমুরগির পেড়ে-রাখা ডিম ওঠানো, শস্য গোলায় (যেখানে শস্যদানা জড়ো করা থাকে) প্রবেশ করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হয়। হিন্দুদের ক্ষেত্রে শুদ্ধীকরণ অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণগণ একাদশ দিবসে, শূদ্ররা তৃতীয়, একাদশতম ও ত্রিশতম দিবসে পালন করে। একজন ব্রাহ্মণ এ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। শিশুর চুল কামানো ও নখ কাটা হয়। শিশু ও মাতা উভয়ে স্নানের পর নতুন কাপড় পরে। প্রসব দূষণের দরুন অন্তরালে থাকাকালে তারা যা কিছু ব্যবহার করেছে সবই পরিত্যাগ করা হয়। স্নানের পর মাতাকে স্বল্পপরিমাণ পঞ্চগব্য, যাতে পাঁচটি মৌলিক পদার্থ আছে, যথা ঘি, মধু, দুধ, গঙ্গাজল, গো-চানা খাওয়ানো হয়। তারপর তাকে পঞ্চব্যঞ্জনের খাবার পরিবেশন করা হয়। সূর্যার্ঘ্য পূজা সমাপনের পর তাকে অাঁতুড় ঘর ত্যাগ করতে দেওয়া হয়, তবে তারপরও কিছুকাল পর্যন্ত তাকে অপবিত্র ধরা হয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ে শিশুর জন্ম তার গোত্রের সব আত্মীয়দেরকেই দূষিত করে এবং তাদের কেউ দূষণ অবস্থা বিদূরিত হওয়ার আগে পূজা-অর্চনা করতে পারে না। মুসলমানদের ক্ষেত্রে শিশুর জন্ম প্রসবকারিণী ছাড়া পরিবারের অন্য কাউকে অপবিত্র করে না। বাচ্চাকে মন্দ আত্মা থেকে রক্ষা করার জন্য অাঁতুড়ঘরে তার তিন থেকে সাতদিন পর্যন্ত থাকা কাম্য। মায়ের ওপর জিন/ভূতের ভর করার আশঙ্কা থাকে, কারণ দুষ্ট আত্মাগণের দূষিত রক্ত ও বুকের দুধের প্রতি লোভ থাকে। যখন প্রসবকারিণী মহিলা প্রস্রাব বা মলত্যাগের জন্য বাইরে বের হয়, সবরকমের বিপদ এড়ানোর জন্য সে চুল ঢেকে রাখে, কোন লোহার টুকরা বা চাবির গোছা সাথে রাখে এবং চলার পথে পানি ছিঁটিয়ে নেয়। অাঁতুড়ঘরে প্রবেশের আগে অগ্নিপাত্রের চারদিকে চক্কর দিয়ে নেয় এবং হাত-পা গরম করে নেয় যাতে তার সাথে-আসা কোন মন্দ সম্মোহন হয়ে থাকলে তা কেটে যায়। মুসলমান মা সপ্তম দিবসে স্নান করে নতুন কাপড় পরে। তাকে পাঁচ বা সাত পদের বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। তারপর তাকে অাঁতুড় ঘর ত্যাগ করতে দেওয়া হয়।
নতুন মায়ের খাদ্য ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কি করণীয় তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে স্থির করা হয়, যেন পরিপাকতন্ত্রকে এসব খাদ্য ব্যাহত না করে এবং গর্ভকালীন কারণে সঞ্চিত বাড়তি তরল পদার্থ থেকে মুক্ত হয়ে সে প্রয়োজনীয় উত্তাপ ও শক্তি আহরণ করতে পারে। যেসব হাল্কা গরম খাদ্য দেওয়া হয় সেগুলি হচ্ছে ঘি, মধু, দারুচিনি, আদা, রসুন, লবঙ্গ, জায়ফল এবং এলাচ। গরম খাদ্য, যথা মাংস, ডিম, বড় মাছ, ডাল, মরিচ ইত্যাদি পরিহার্য। শীতল খাদ্য হচ্ছে তরলজাতীয় সবজি, দই ইত্যাদি; শুকনা খাবার হচ্ছে সেদ্ধ করা চাল, ভাত, মুড়ি-চিড়া-খৈ, গুড়, রুটি, গুঁড়ো করা মসলা, স্বাদ বৃদ্ধিকারক তৃণ, পুদিনা, ধনে পাতা, কালিজিরা ইত্যাদি। প্রসবের পর মাতাকে অন্তত তিনদিন ভাত দেওয়া হয় না। স্বীকৃত পথ্য হচ্ছে কোন কোন উদ্ভিদের রস সহকারে গরম ও শুকনো খাবার এবং গরম চা। আর্দ্র বা রসালো খাবার পরিহার্য হলেও মায়ের জন্য বিশেষ ধরনের এক স্যুপ বানানো হয় যা তাকে তৃতীয় বা সপ্তম দিনে দেওয়া হয়। রজত, নিম, ধানকলস, আমতল বাসক, থানকুনি ও রাজমাণিকের পাতা দিয়ে আঠার মতো বানানো হয়। তারপর দু একটি শিং মাছ বা একটি জবাই-করা কবুতর ফুটন্ত স্যুপে মেশানো হয়। মা এই স্যুপের সাথে প্রথমবার ভাত খায়। গাছপালা দিয়ে ঘরে তৈরি কয়েকটি উপাদান ব্যবহারে প্রসবোত্তর সময়ে কিছু জটিলতা এড়ানো যেতে পারে এবং তা দ্রুত আরোগ্যলাভে সহায়ক হয়। মধু ও ঘি মিশ্রিত গুঁড়ো-করা শুকনা নিম পাতা ও পাট ব্যথার উপশম করে, ডিম্বনালীর ঘা শুকাতে সাহায্য করে এবং তাতে পা ফুলে যাওয়া, গর্ভাশয়ের সংকীর্ণ অংশের ব্যথা, খাদ্যভীতি, বদহজম ও মাথা ঘোরা এড়ানো যেতে পারে। প্রসবের অব্যবহিত পরেই কোন কোন অভ্যাস দ্বারা প্রসবোত্তর জরায়ুসংক্রান্ত অসুখ এড়ানো যেতে পারে। বিশ্বাস করা হয় যে, প্রসবের পরপরই মায়ের মাথার তালুতে পায়রার উষ্ণ রক্ত মালিশ করলে ‘একলামসিয়া’ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। তেমনি চালতার পাতার প্রলেপে সুতিকা (প্রসবোত্তর উদরাময়) এড়ানো যেতে পারে। আদা ও রসুন গুঁড়ো করে সাথে সাথে ধূমায়িত গরম তেলে মিশিয়ে মাথার তালুতে মালিশ করলে মাথার জ্বালাযন্ত্রণা রোধ করা যায়। আর্দ্র ও রসালো খাদ্য এড়াতে পারলে দেহের স্ফীতি এড়ানো যেতে পারে। বিশ্বাস করা হয়, যত বেশি রক্তের নির্গমন, তত শীঘ্র আরোগ্যের সম্ভাবনা। গরম সেঁক দেহের দূষিত রক্ত নির্গমনের সহায়ক। বিশ্বাস করা হয় যে, প্রসবের পর ইঞ্জেকশন জমাট রক্ত নির্গমনের পথে অন্তরায় হয় যে কারণে অতিশয় স্থূলতা, গর্ভাশয়ের সংকীর্ণাংশের ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। এসব ইঞ্জেকশন স্তনে দুধের প্রবাহও শিথিল করে দেয়। তাই মহিলারা আধুনিক ঔষধ এড়াতে চায়।
বাংলাদেশের নগর এলাকায় প্রসবকালীন আচার-অনুষ্ঠানে তেমন কোন পার্থক্য নেই। বড় পার্থক্য কেবল এই যে, নগর এলাকায় অধিকাংশ প্রসবই হাসপাতালে করানো হয়, মা ও শিশু উভয়েই আধুনিক চিকিৎসা লাভ করে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সমান্তরালভাবে শহরের ও পল্লীর জনগণ বিবিধ লোকজ্ঞান ও প্রথাসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে চলেছে, তবে সবাই অবশ্য নির্বোধের মতো অন্ধবিশ্বাসে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে না। তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও আর্থিক অবস্থার মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল থেকেই তারা উক্ত জ্ঞান অর্জন করে ও তা প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করে থাকে। [সুলতানা মুস্তাফা কামাল]