রেজা খান
রেজা খান মুগলদের হাত থেকে বাংলার শাসনক্ষমতা যখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছিল, সেসময় বাংলার নায়েব নাজিম ও নায়েব দীউয়ান ছিলেন। নওয়াব আলীবর্দী খানের শাসনামলে পারস্যের এক ভাগ্যান্বেষী রেজা খান নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার (১৭৫৬-৫৭) মাতা আমিনা বেগমের সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্কের সূত্র ধরে বাংলায় আসেন। রেজা খান অতি দ্রুত তৎকালীন বাংলার রাজনীতিতে স্বীয় অবস্থান করে নেন। ১৭৫৬ সালে কাটোয়ার ফৌজদার পদে নিয়োগের পর থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৭৬০ সালের প্রথম দিকে মীরজাফর তাঁকে ইসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) ফৌজদার পদে পদোন্নতি দেন। ১৭৬৩ সালে রেজা খান সুবাহ বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরের (ঢাকা) নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। বাণিজ্যিক লেনদেন ও রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি লাভের পর ক্লাইভ তাঁকে বাংলার নায়েব দীউয়ান নিযুক্ত করেন। নায়েব দীউয়ান হিসেবে তিনি কোম্পানির পক্ষে দীউয়ানি শাসন পরিচালনা করতেন। একই সময়ে মীর জাফরের পুত্র নাজমুদ্দৌলার নাবালকত্বের কারণে তাঁকে সুবাহর নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হয়। ১৭৬৫ থেকে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত রেজা খান কার্যত ছিলেন বাংলার প্রকৃত শাসক।
যেমন দ্রুত রেজা খানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠান ঘটেছিল, তেমনি দ্রুত এসেছিল তাঁর পতন। তাঁর উন্নতির মূল উৎস ছিলেন তাঁর পৃষ্ঠপোষক রবার্ট ক্লাইভ। তৎকালীন পরিস্থিতিতে ক্লাইভ এ দেশে কোম্পানির সরাসরি রাজ্যজয়ের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন পরোক্ষভাবে দেশে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে কোম্পানির জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের পক্ষপাতী। বাংলায় ক্লাইভের এই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ঐতিহাসিকগণ ‘দ্বৈত শাসন’ বলে আখ্যাত করেছেন। ১৭৬৭ সালে তাঁর দেশে ফিরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় ক্লাইভ প্রবর্তিত ব্যবস্থা সকল স্বার্থগোষ্ঠীর সন্তোষমাফিক কাজ করেছে। কিন্তু তখন থেকে তিনি প্রশাসনের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। স্থানীয় কোন প্রতিনিধি ছাড়াই কোম্পানির কর্মচারীরা দীউয়ানি পরিচালনায় ক্রমাগত আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। এই প্রবণতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় যখন রেজা খানের নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতাকে রোধ করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপীয় অফিসারদের জেলা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয় (১৭৬৯)। পরিশেষে তিনি পদচ্যুত হন এবং ১৭৭২ সালে কারারুদ্ধ হন। তাঁর বিরুদ্ধে বহুবিধ দুর্নীতি ও উৎপীড়নের অভিযোগ এনে বিচার করা হয়। এই বিচার চলাকালে রেজা খান সাফল্যের সঙ্গে প্রমাণ করেন যে, কিভাবে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ ও অত্যাচারী কোম্পানি অফিসারদের অপকর্মের ভারবাহী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। অবশ্য ১৭৭৫ সালে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে তিনি নায়েব দীউয়ান ও নায়েব নাজিমের পদে পুনর্বহাল হন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের অধীনে এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের কঠোর শাসনে উপনিবেশিক রাষ্ট্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং এই প্রক্রিয়ার ফলে প্রশাসন থেকে স্থানীয় লোকেরা অপসারিত হতে থাকেন অথবা তাদের অবস্থান অকিঞ্চিৎকর অবস্থায় পর্যবসিত হয়। স্বীয় পদে পুনর্বহালের পর রেজা খান অবশ্য বাংলার নামমাত্র নায়েব নাজিম হিসেবে কাজ করতে থাকেন। অবশেষে ১৭৯১ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস এই খেতাবসার পদটি বিলুপ্ত করেন। হতাশাগ্রস্ত রেজা খানের কিছুকাল পরেই মৃত্যু হয়।
রেজা খান ছিলেন ঐ সময়ের দেশীয় ঐসব এলিটদের প্রতিনিধি, যাঁরা প্রথম দিকে ব্রিটিশের সহযোগিতা করেন, অথচ পরে শাসনপদ্ধতি নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হন। দেশীয় এলিটরা ‘নিয়াবত’সহ প্রশাসনের সনাতন প্রতিষ্ঠানগুলি সংরক্ষণের পক্ষপাতী ছিলেন; ফোর্ট উইলিয়ম কর্তৃপক্ষ এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও এর সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রবর্তনের ফলে উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং প্রশাসন থেকে স্থানীয় উপাদানগুলি সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়। [সিরাজুল ইসলাম]