রেশমপোকা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

রেশমপোকা (Silkworm)  বাণিজ্যিকভাবে মূল্যবান প্রাকৃতিক রেশম উৎপাদন করে, Lepidoptera বর্গের এমন কতক লার্ভার সাধারণ নাম। এরা হতে পারে Bombycidae গোত্রের তুঁতগাছের রেশমপোকা (Mulberry silkworm, Bombyx mori) ও অন্য গাছের রেশমপোকা, যেমন Saturniidae গোত্রের এরি রেশমপোকা (Eri silkworm, Samia cynthia ricini), মুগা রেশমপোকা (Muga silkworm, Antheraea assama), তসর রেশমপোকা (Tasar silkworm, A. mylitta ও A. paphia) ইত্যাদি। ধারণা করা হয়, মূল মান্দারিন রেশমপোকা (Mandarin silkworm, B. mandarina) থেকে উদ্ভূত হয়ে B. mori এখন পুরোপুরি পোষা গৃহপালিত পতঙ্গে পরিণত হয়েছে এবং রেশম উৎপাদক অতি গুরুত্বপূর্ণ পতঙ্গ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বস্ত্রজগতে ‘রেশম’ বলতে তুঁতগাছের রেশমকেই বোঝায়। কারণ, পৃথিবীর সর্বমোট উৎপন্ন রেশমের শতকরা ৯৫ ভাগই আসলে তুঁত রেশম। তুঁতগাছের রেশমপোকা ছাড়া আরেকটি পোষা পতঙ্গ এরি রেশমপোকা রেশম উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। মুগা রেশমপোকা আধা-পোষা পতঙ্গ এবং তসর রেশমপোকা বন্য প্রজাতি। রেশমপোকা প্রতিপালনের মাধ্যমে রেশম উৎপাদনকে রেশমচাষ (Sericulture) বলে।

রেশমপোকার রূপান্তর সম্পূর্ণ ধরনের। এখানে জীবনচক্রের সবগুলি পর্যায়, যেমন ডিম থেকে লার্ভা, লার্ভা থেকে পিউপা ও সবশেষে পিউপা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক দশাগুলি বিদ্যমান। লার্ভার শেষ পর্যায়ে গুটিকা (Cocoon) তৈরি হয়, রেশম সুতা বের করা হয় এই গুটিকা থেকেই। উৎপন্ন রেশমের মান আহার্য উদ্ভিদের পাতার ধরন, বার্ষিক প্রজনন সংখ্যা ইত্যাদির নিরিখেই নির্ণয় করা হয়।

বিভিন্ন রেশমপোকার খাদ্য উদ্ভিদগুলির মধ্যে উলে­খযোগ্য, B. mori-র জন্য তুঁতগাছ (Morus alba,  M. indica); S. c. ricini-র জন্য রেড়িগাছ (Ricinus communis), Antheraea assama-র জন্য সোম (Machilus bombycina) ও কুকুরচিতা (Litsea monopetala), এবং A. mylitta ও A. paphia-র জন্য যথাক্রমে অর্জুন (Terminalia arjuna) ও শাল (Shorea robusta) এবং লুটকি/দাঁতরাঙা (Melastoma malabathricum)।

রেশম আসলে রেশমপোকার রেশমগ্রন্থি নিঃসৃত উজ্জ্বল তন্তুবিশেষ। রেশমের আছে কতিপয় অনন্য গুণ; প্রাণী দ্বারা তৈরি সূক্ষ্মতম (১০-১২m) তন্তু, দেহকোষের অংশ না হওয়ার জন্য এর কোন কোষকাঠামো নেই এবং এটি অবিচ্ছিন্ন তন্তু। রেশমপোকা তার দেহের উভয় পাশের দুটি রেশমগ্রন্থিতে পোষক গাছের পাতা থেকে রেশম প্রোটিন সংশে­ষ করে। রেশমপোকার লার্ভা পরিণত হয়ে উঠলে রেশমগ্রন্থি পূর্ণ বিকশিত হয় এবং মুখ সংলগ্ন স্পিনারেট-এর মাধ্যমে তরল পদার্থ নিঃসরণ শুরু করে, যা বাতাসের সংস্পর্শে এসে মসৃণ অাঁশে পরিণত হয়। রেশম তন্তু পিউপাকে ঘিরে গুটিকা  বা কোকুন নামে এক নিরাপত্তামূলক আবরণ সৃষ্টি করে। গুটিকা থেকে রেশম সংগৃহীত হয়।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে B. mori চাষ হয়। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য লোকে তুঁতগাছের রেশমপোকা multivoltine জাতগুলি প্রায় এককভাবে চাষ করে। অবশ্য পরীক্ষামূলকভাবে কিছু bivoltine জাতের রেশমপোকার চাষও হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ও ইনস্টিটিউট অব ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলজি সাভার, ঢাকা পরীক্ষামূলকভাবে S. c. ricini নামক রেশমপোকা প্রতিপালন করছে। বর্তমানে দেশের রেশমচাষিদের কাছে এরি রেশমপোকা চাষের বাণিজ্যিক গুরুত্ব নেই।

প্রাচীনকাল থেকেই রেশমপোকার প্রতিপালন চলে আসছে। এই পতঙ্গের প্রধান রোগসমূহ হলো: পেবরাইন (pebrine), ফ্ল্যাচেরি (flacherie), মাসকার্ডাইন (muscardine) ও গ্র্যাসারি (grasserie)।

রেশমপোকা

এছাড়া রেশমপোকা উজিমাছি (Uzi fly, Exorista sorbillans), পিঁপড়া, ঘুগড়াপোকা, ইয়ারউইগ, টিকটিকি, কাঠবিড়ালী, ইঁদুর ও বেশ কিছু পরজীবী ও ক্ষতিকর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশসহ সব গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে উজিমাছিই রেশমপোকার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে।

রেশমচাষ  রেশম সুতা উৎপাদনের লক্ষ্যে রেশমপোকা প্রতিপালন। রেশম উৎপাদন বা রেশমচাষ প্রথম চীন দেশে উদ্ভাবিত হয়। এর কলাকৌশল চীনারা গোপন রাখলেও শেষ পর্যন্ত বাইরে পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ইতালি, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া ও ভারতের রেশমশিল্প যথেষ্ট উন্নত। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২৮,০০০ পাউন্ড (১২,৭০০ কেজি) রেশমসুতা উৎপাদন করে। রেশমচাষের তিনটি সুচিহ্নিত পর্যায়: তুঁতগাছ চাষ, রেশমপোকা পালন, এবং কাপড় তৈরির জন্য রেশমগুটির সুতা পৃথক করা। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় কৃষিভিত্তিক, কিন্তু সুতা তৈরির জন্য গুটি খোলা স্পষ্টতই শিল্পগত ব্যাপার, যা নিষ্পন্ন হয় কুটির শিল্প ধরনের প্রতিষ্ঠানে বা ফিলাচার (filature) নামের কারখানায়।

বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রেশমপোকা প্রজাতিগুলি Bombyx mori, Samia cynthiaicini, Antheraea assama, A. paphia, A. mylitta ইত্যাদি। রেশম উৎপাদক এসব কীটের মধ্যে তুঁত রেশমপোকা সর্বাধিক ব্যবহূত, নিবিড়ভাবে প্রতিপালিত এবং এর পালন কৌশলও যথেষ্ট উন্নত। B. mori এশীয় প্রজাতি, আর এর লার্ভা অত্যন্ত মিহি রেশম বানায়। বাংলাদেশে, বিশেষত রাজশাহী ও নবাবগঞ্জ জেলায় এর চাষ খুবই ব্যাপক।

একমাত্র তুঁতগাছই রেশমপোকার খাবার জোগায়। Moraceae গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ প্রজাতি Morus alba চরম আবহাওয়া সহিষ্ণু। বাংলাদেশে রেশমপোকা পালনের জন্য M. alba ও M. indica এই দুই জাতের তুঁত চাষ হয়। সফল রেশম চাষের জন্য রেশমপোকাদের তাজা তুঁতপাতা খাওয়ানো দরকার। কিন্তু তুঁতগাছের নানা রোগের জন্য পাতা যোগানো অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। এগুলির মধ্যে উলে­খযোগ্য Phyllactinia corylea ছত্রাক থেকে পাউডারি মিলডিউ বা ছাতরা রোগ,  পাতার নানা দাগরোগ, বিশেষত Cercospora moricola থেকে উৎপন্ন রোগটি। এছাড়া কতক কীটপতঙ্গও তুঁতগাছের ক্ষতি করে: শুঁয়াপোকা Spilarctia obliqua, কাটুইপোকা Spodoptera litura, কান্ড ছিদ্রকারী Apiona germarii, ঘাসফড়িং Neorthocris acuticeps, Pseudodendrothrips mori, গলমিজ Diplosis mori, উইপোকা ইত্যাদি।

শুধু লার্ভা পর্যায়েই রেশমপোকারা খাবার খায়। অপরিণত পর্যায়গুলিতে রেশম উৎপাদনের সময়কাল এবং রোগ প্রতিরোধ সবই পুষ্টি প্রভাবিত। ডিম থেকে বের হওয়ার পরই লার্ভা তুঁতপাতা খেতে শুরু করে এবং তা পিউপা পর্যায়ের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ঐ সময় লার্ভা রেশমগ্রন্থির রস দিয়ে একটি রেশমি গুটি বানাতে থাকে। প্রজননতন্ত্র ও বয়স্ক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হলে লার্ভা গুটির ভিতর পিউপা পর্যায়ে পৌঁছয়। গুটি থেকে পরে পরিণত মথ বের হয়ে আসে এবং অল্পকালের মধ্যেই জীবনচক্র পুনরাবৃত্ত হতে থাকে।

রেশমপোকার পুষ্টির অপরিহার্য উপাদান হলো শর্করা- গ­ুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ম্যালটোজ, সুক্রোজ ইত্যাদি এবং সেসঙ্গে অ্যামিনো অ্যাসিড্স্, চর্বি ও তৈল, নানা ভিটামিন। হরমোন রেশমগ্রন্থির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরোক্ষভাবে রেশম উৎপাদন বাড়ায়।

রেশম একটি পেলব, ঈষদচ্ছ, কঠিন অাঁশ, তাতে আছে সেরিসিন নামের প্রোটিনের আবরণ। রেশম অাঁশের ভেতরের মজ্জায় থাকে ৭৫-৮০ শতাংশ ফাইব্রইন ও বাহিরের খোলে ২০-২৫ শতাংশ সেরিসিন। রেশম তরল হিসাবে নিঃসৃত হয়ে বাইরে এসে কঠিন আকার পায়। রেশমপোকা nuclear polyhedrosis (Grasserie), cytoplasmic polyhedrosis, infectitious flacherie ও densonuclosis জাতীয় ভাইরাস রোগসহ অনেকগুলি অসুখেই ভোগে। এগুলির মধ্যে আছে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ- bacterial septicemia, bacterial toxicosis, পরিপাকতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ; ছত্রাকঘটিত সাদা ও সবুজ muscardine, aspergillosis ইত্যাদি এবং প্রোটোজোয়াজনিত pebrine। বাংলাদেশে রেশমচাষ এসব রোগে, বিশেষত গরম ও আর্দ্র মাসগুলিতে (জুন-আগস্ট) খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গুটি থেকে কাঁচা রেশম উৎপাদনের সবগুলি প্রক্রিয়াই ‘ফিলাচার’ সম্পন্ন করে, যথা: শুকানো, মজুতকরণ, গরম পানিতে সিদ্ধ করা, সুতা পৃথক করা, বুকিং ও গাঁইট বাঁধা। গুটি থেকে মথ বের হবার পূর্বেই তা পানিতে সিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণত পাকানোর কাজটি খুব সাধারণ হস্তচালিত যন্ত্র চরকা দিয়ে করা হয়, আর এটি বানাতে পারে গ্রামীণ মিস্ত্রিরাও। বড় বড় কারখানায় পাকানোর কাজটি অবশ্য যন্ত্রীকৃত। কাঠিম থেকে কাঁচা রেশম তুলে আবার পেঁচানোর পর পেটি বানিয়ে সেগুলি গাঁটারিবন্দী হয়।

দেশে রেশম চাষ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য সরকার রাজশাহীতে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতির ৬২নং অধ্যাদেশ দ্বারা রাজশাহীতে প্রধান কার্যালয়সহ বাংলাদেশ রেশম বোর্ড গঠিত হয়। রেশমচাষ মূলত নবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট ও শিবগঞ্জ উপজেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে রেশমচাষ ৩৬টি জেলার ১৯০টি উপজেলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৮টি রেশম শিল্প কারখানার মধ্যে রয়েছে দিনাজপুরের জয় সিল্ক মিলস লিমিটেড, নওগাঁর উত্তরা সিল্ক মিলস লিমিটেড, রাজশাহীর সুরভি টেক্সটাইল লিমিটেড ও ঢাকার বেনারসী সিল্ক ইন্ড্রাট্রিস। এ ছাড়া আরও অনেকগুলি বেসরকারি সংস্থা এখন রেশমচাষের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে উচ্চফলনশীল জাতের কিছু তুঁত ভ্যারাইটি উদ্ভব করেছে। সেগুলির অধিকাংশই এখন শুধু গবেষণা সংস্থার চৌহদ্দির মধ্যেই সীমিত রয়েছে। ব্যবসায়িকভাবে পাতা উৎপাদনের জন্য এসব জাতের তুঁত হস্তান্তর ও চাষের ব্যাপারে আবশ্যকীয় কর্মনীতি/সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কয়েকটি উচ্চফলনশীল ও বহুচক্রী (multivoltine) রেশমপোকার জাত অবমুক্ত ও হস্তান্তর করেছে, যাতে আছে জ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র মাসের উপযোগী প্রতিরোধক্ষম ও উচ্চফলনশীল জাত। মাঠপর্যায়ে উন্নততর ফলপ্রসূতার জন্য কয়েকটি multi bivoltine ও multi  multivoltine সংযোজন সুপারিশ করা হয়েছে।

রেশমচাষ উন্নয়নের জন্য কৃষকদের শিক্ষা  ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রসারণকারী এবং টেকনিক্যাল কর্মীদেরও যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অধিকন্তু বর্তমান গবেষণাগারগুলিকে আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত ও সম্প্রসারিত করলে এবং গবেষক ও কৃষক উভয়কে পর্যাপ্ত অর্থযোগান দিলে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ রেশম বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে

[মো. আতাউর রহমান খান]

আরও দেখুন তুঁত; বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ রেশম বোর্ড।