মন্ড

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মন্ড  কাগজ উৎপাদনে ব্যবহার্য অাঁশযুক্ত সেলুলুজসমৃদ্ধ দ্রব্য। মন্ড তৈরির মুখ্য কাঁচামাল নানা ধরনের কাঠ; তবে তুলা, লিলেন, ছেড়া জামাকাপড়, খড়, আখের ছোবড়া, বাঁশ ইত্যাদিও ব্যবহূত হয়। কাগজের মান বা চাহিদা অনুযায়ী এক বা একাধিক ধরনের মন্ড ব্যবহূত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় কাগজ উৎপাদন কম। তাই কিছু পরিমাণ কাগজ, বোর্ড তৈরির মন্ড ইত্যাদি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।

মন্ড তৈরির শিল্প-কারখানা  বাংলাদেশে সরকারি মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে চারটি মন্ড কারখানা রয়েছে: কর্ণফুলি পেপার মিলস (KPM), সিলেট পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস (SPPM), নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস (NBPM) এবং খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস (KNM)। এ মিলগুলি বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প কর্পোরেশন (Bangladesh Chemical Industries Corporation) পরিচালনা করে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আরও চারটি মন্ড কারখানা বসুন্ধরা পেপার মিলস, সোনালী পেপার মিলস, মাগুরা পেপার মিলস এবং টঙ্গি বোর্ড মিলস ঢাকা শহরের নিকটে অবস্থিত।

সরকারি তদারকিতে পরিচালিত মিলগুলির মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলি পেপার মিলস, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস এবং খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস; এগুলি সমন্বিত মন্ড ও কাগজের মিল। অপরদিকে সিলেট পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস কেবল বাজারজাত করার উপযোগী মন্ড উৎপাদন করে। বেসরকারি খাতের চারটি মিল মন্ড তৈরিতে পরিত্যক্ত কাগজ (waste paper) ব্যবহার করে। এছাড়া মন্ড আমদানি ও বাজারজাতও করে থাকে। দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগৃহীত পরিত্যক্ত কাগজ যথেষ্ট পরিমাণ নয় বলে বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মন্ড আমদানি করা হয়।

কর্ণফুলি পেপার মিলস ক্রাফট পদ্ধতিতে মন্ড উৎপাদন করে। এখানে বাঁশ ও কাঠ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। তবে বাঁশ যথেষ্ট পরিমাণে সহজলভ্য না হওয়ার কারণে অন্যান্য শক্ত মিশ্র কাঠ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে।

মন্ড তৈরিকরণ  প্রধানত তিনটি প্রক্রিয়ায় মন্ড তৈরি করা হয়, যেমন যান্ত্রিক, আধারাসায়নিক এবং রাসায়নিক। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাঠের গুঁড়া থেকে সরাসরি মন্ড তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে কাঠকে যন্ত্রের সাহায্যে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়। কাঠের ফালি (chips) থেকে মন্ড তৈরি করা গেলেও বাংলাদেশে সে মন্ড দিয়ে কাগজ তৈরি হয় না, কেবল গুঁড়া কাঠ থেকেই হয়। মন্ড তৈরির জন্য হালকা রঙের, লম্বা অাঁশবিশিষ্ট নরম কাঠ বেশি উপযোগী। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের কাঠ তেমন জন্মায় না। গেওয়া কাঠ (Excoecaria agallocha) সামান্য রাসায়নিক শোধনের পর চূর্ণ কাজে ব্যবহূত হয়। এক্ষেত্রে মন্ডের উৎপাদন মাত্রা শতকরা ৯৫ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। চূর্ণ করার যন্ত্রের ধার ও কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে প্রতি টন মন্ড উৎপাদনে শক্তি ব্যয় হয় ১০০০-১৫০০ kwh।

আধা-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মন্ড তৈরি দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়: প্রথমত কাঠের পাতলা ফালিগুলিকে রাসায়নিক দ্রব্যের সঙ্গে মিশানো হয়; ফলে কাঠ আংশিকভাবে লিগনিনমুক্ত ও নরম হয়। দ্বিতীয় ধাপে নরম ফালি থেকে অাঁশ পৃথক করা হয়। এ পদ্ধতিতে মন্ড উৎপাদনের পরিমাণ ৫৫-৮০%। এ পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার আছে এবং সাধারণত নিম্নগুণ সম্পন্ন কাগজ উৎপাদনে এ প্রক্রিয়ায় তৈরি মন্ড ব্যবহূহ হয়।

পূর্ণ রাসায়নিক পদ্ধতিতে কাঠের গুঁড়ার মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য যোগ করে উচ্চ তাপে ও চাপে জ্বাল দেওয়া হয়। এতে লিগনিন গলে যায় এবং ফাইবারগুলি কাঠের অন্যান্য উপাদান থেকে সহজেই পৃথক হয়ে যায়। তবে অাঁশের প্রাচীরে কিছু পরিমাণ লিগনিন থেকেই যায়। সম্পূর্ণ লিগনিন দূর করলে মন্ডের মানগত অবনতি ঘটে। এ কারণে এ প্রক্রিয়ায় মন্ড উৎপাদনে শক্ত কাঠের ক্ষেত্রে শতকরা ৩-৪ ভাগ এবং তুলনামূলকভাবে নরম কাঠের ক্ষেত্রে শতকরা ৪-১০ ভাগ লিগনিন সাধারণভাবে রাখা হয়। পরবর্তীতে ব্লিচিং (bleaching) করার সময় ইচ্ছে করলে বাকি লিগনিনও দূর করা যায়। বিভিন্ন রাসায়নিক পদ্ধতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সোডা (soda), ক্রাফট (craft) এবং সালফাইট (sulphite) পদ্ধতি। ক্রাফট ও সালফাইট পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহূত হয়।

মন্ড তৈরির কাঠ  সাধারণ কাঠ ছাড়াও শতকরা অন্তত পাঁচ ভাগ মন্ড তৈরি হয় বাঁশ, আখের ছোবড়া, খড় ইত্যাদি উৎস থেকে। মন্ড তৈরির সবচেয়ে পছন্দনীয় কাঁচামাল কোনিফারজাতীয় (coniferous) কাঠ অথবা অন্য কোন নরম কাঠ। যদিও সম্প্রতি শক্ত কাঠও (hardwoods) ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়, কিন্তু তা থেকে তৈরি মন্ড নরম কাঠের মন্ডের অনুরূপ হয় না। এ কারণে শক্ত কাঠকে মন্ড উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয় না।

বাংলাদেশে মন্ড উৎপাদনের জন্য যেসব গাছ ব্যবহূত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গামার (Gmelina arborea), শিমুল, (Bombax ceiba), কদম (Anthocephalus chinensis), পিতরাজ (Amoora species), Albizia falcataria ইত্যাদি। এসব গাছের কাঠ থেকে সাধারণত রাসায়নিক পদ্ধতিতে মন্ড তৈরি করা হয়। নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনের জন্য মন্ড তৈরি হয় গেওয়া গাছ থেকে। এছাড়া বর্তমানে বিদেশি কয়েকটি বৃক্ষ যেমন, আকাশমণি (Acacia auriculiformis), ম্যানজিয়াম (A. mangium) এবং ইউক্যালিপ্টাস থেকে বাংলাদেশে কিছু পরিমাণ মন্ড তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশে উৎপন্ন মন্ড তেমন উন্নতমানের নয়। ফলে বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতমানের মন্ড আমদানি করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মন্ড উৎপাদনে পাটের অাঁশ এক সম্ভাবনাময় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তবে এজন্য প্রক্রিয়াজাতকরণের নতুন পদ্ধতি উদ্ভব করা প্রয়োজন হবে।  [এ.কে.এম আখতারুজ্জামান]

আরও দেখুন কাগজ