মজিদ, মোহাম্মদ ইশফাকুল
মজিদ, মোহাম্মদ ইশফাকুল (১৯০৩-১৯৭৩) সমরনায়ক, ক্রীড়াবিদ ও প্রথম বাঙালি মেজর জেনারেল। তিনি ১৯০৩ সালের ১৭ মার্চ আসামের জোড়াহাটে জন্মগ্রহণ করেন।
আসামের গুয়াহাটি কটন কলেজে পড়ালেখা সমাপ্ত করে ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি কলেজে যোগ দেন। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি কলেজে কেবল ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯১৮ সালে প্রথম দুজন ভারতীয় ক্যাডেট স্যান্ডহাস্টে প্রশিক্ষণের জন্যে নির্বাচিত হন। ইশফাকুল মজিদ চৌকস ও মেধাবী ছিলেন। তিনি স্যান্টহাস্টে দ্বিতীয় ক্যাডেট এবং বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম। ইশফাকুল মজিদের পর আর কোনো বাঙালি ক্যাডেট ব্রিটিশ এই মিলিটারি কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। ১৯৩২ সালে ভারতের দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী চালু হওয়ার পর স্যান্ডহাস্টে ভারতীয়দের প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৪ সালের ১০ জুলাই ইশফাকুল মজিদ সফলতার সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ঐ ব্যাচের ১৮ জনই ব্রিটিশ এবং মজিদসহ মাত্র ৩ জন ছিলেন ভারতীয়।
কমিশনপ্রাপ্ত ইশফাকুল মজিদ ১৯২৪ সালের ২৯ আগস্ট লিংকনশায়ার রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের অফিসার হিসেবে লক্ষ্ণৌ ও রাণীক্ষেতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্টে (৪/১৯) যোগ দেন এবং তার চাকুরীর বেশির ভাগ সময় এই রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। অবশ্য তিনি কখনো কখনো ১০/২৯তম হায়দারাবাদ ও ১১/১৯তম হায়দরাবাদ রেজিমেন্টে সাময়িকভাবে সংযুক্ত থেকে বেনারস ও ডিমাপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে লেফটেন্যান্ট এবং ১৯৩৩ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি আগ্রায় কুমায়ুন (KUMAON) রেজিমেন্ট (পূর্বতন হায়দরাবাদ রেজিমেন্ট) সেন্টারের কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি আগ্রায় সেন্ট্রাল কমান্ড হেডকোর্য়াটারে জেনারেল জিওফ্রি স্কুলের স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হন। এরপর তিনি কলকাতায় ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাসিটেন্ট অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। ইশফাকুল মজিদ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে ভারতের বাইরে ইরাক ও সিঙ্গাপুরে চাকুরি করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল থিমায়া ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান হায়দারাবাদ রেজিমেন্টে মজিদের সহকর্মী ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক ব্যক্তিকে জরুরিভিত্তিতে এবং সাময়িকভাবে সেনাবাহিনীতে সৈনিক ও অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তাদেরকে ক্ষতিপূরণসহ অব্যাহতি দেওয়া হয়। ইশফাকুল মজিদকে রি-সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তিনি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসামের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সৈনিকদের পুনর্বাসনের জটিল কাজ দক্ষতার সাথে পালন করেন। ১৯৪৬ সালে সামরিক অফিসার হিসেবে ইশফাকুল মজিদ কলকাতায় সংঘটিত ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে মজিদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তানে তিনি দশম ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড ও ৫১তম ব্রিগেড গ্রুপের অধিনায়কত্ব করেন। এরপর তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ৯৪ ইনফ্রেন্টি ডিভিশনের জিওসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে মজিদ জেনারেল আইয়ুব খানের চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন এবং তাঁর সাফল্য আইয়ুব খানের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তা সত্ত্বেও ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারি ইশফাকুল মজিদকে ডিঙ্গিয়ে আইয়ুব খানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। বিষয়টি মজিদ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ নামে একটি সামরিক ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়। ইশফাকুল মজিদকে এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িয়ে পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করে, কিন্তু বিচারে তিনি বেকসুর খালাস পান। তিনি পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর কয়েক বছর তিনি করাচিতে অবস্থান করে ঢাকার কাছে ফতুল্লায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী নিয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে ইশফাকুল মজিদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান প্রাক্তন সামরিক কর্মচারীদের নিজ পথে তালিকাভুক্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে নিয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্ত্ততিপূর্বে সর্বস্তরের বাঙালি সৈনিকগণ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালের সবগুলি পত্রিকায় দেখা যায়, ২২ মার্চ কর্নেল ওসমানী ও জেনারেল মজিদের নেতৃত্বে প্রাক্তন সৈনিকগণ বায়তুল মুকাররম থেকে মার্চ করে শহীদ মিনার পর্যন্ত যান এবং সেখান থেকে জেনারেল মজিদ ও কর্নেল ওসমানীসহ কয়েকজন জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তাঁকে একটি তরবারি উপহার দেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জেনারেল মজিদকে বন্দি করে মার্শাল ল’ সদর দপ্তরে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীকে কৌশলে বন্দি করার ব্যাপারে সহযোগিতা করা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে দেশাদ্রোহের মামলার সাক্ষী হওয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করা হয় তাঁর ওপর। কিন্তু দেশপ্রেমিক এই বয়োবৃদ্ধ জ্যৈষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা অনমনীয়তার সাথে পাক সামরিক বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করে পাকিস্তানের পক্ষে সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে কারাগারে বন্দি থাকতে হয়।
স্বাধীনতার পর তাকে উঁচু পদে চাকরি বা দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়, কিন্তু বয়স এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তিনি রাজি হননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দি থাকাকালে তাঁর উপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের ফলে তার শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। [আশফাক হোসেন]