বিদেশী মাছ
বিদেশী মাছ (Exotic fish) ক্রমবর্ধমান মাছের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে পুকুর, নালা, খালবিল ও জলাশয়ে চাষযোগ্য ভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা মাছ প্রজাতি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে মাছের কয়েকটি প্রজাতি প্রবর্তনের নজির ইতিহাসে রয়েছে। এদেশে এ বিষয়ক ধারাবাহিক তথ্য না থাকায় এসব মাছের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেওয়া সহজ নয়। সাম্প্রতিক কালে এদেশে আনা বিদেশী মাছের মধ্যে অধিক উল্লেখযোগ্য হলো চীনা সিলভার কার্প (Hypopthalmichthys molitrix), গ্রাস কার্প (Ctenopharyngodon idellus), বিগহেড কার্প (Aristichthys nobilis), ব্ল্যাককার্প (Mylopharyngodon pisceus) ও কমন কার্প। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে আনা তেলাপিয়া (Oreochromis mossambicus) বাংলাদেশে প্রথম বিদেশী মাছ। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমদানিকৃত ১৫০ প্রজাতির বিদেশী মাছের অধিকাংশই ছিল অ্যাকোয়ারিয়ামের বাহারি মাছ। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে প্রবর্তিত হয় লার্ভাভুক Gambusia মাছ।
পুকুরে চাষযোগ্য মাছের মধ্যে গ্রাসকার্প ও সিলভার কার্প আনুষ্ঠানিকভাবে যথাক্রমে ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে প্রবর্তিত হয়। অবশ্য, পুকরের বহু জনপ্রিয় মাছ এই সময় বা তার আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমানা ডিঙিয়ে দেশে ঢুকে পড়ে। যেভাবেই হোক, অধিকাংশ প্রজাতি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং মাছচাষীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
বাণিজ্যিক মৎস্যচাষে যথেষ্ট অবদান রেখেছে এমন বিদেশী জাতের মাছের মধ্যে রয়েছে চীনা সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বড়মাথা কার্প, সাধারণ কার্প, তেলাপিয়া, ক্যাটফিশ, থাই মাগুর, থাই পাঙ্গাশ, রাজপুঁটি ইত্যাদি। ডোবা ও পুকুরে চাষযোগ্য অন্য কয়েকটি প্রজাতির মাছের সুপারিশ এখনও বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। পুকুরের উপযোগী কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী মাছের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
তেলাপিয়া ১৯৫৪ সালে প্রথম থাইল্যান্ড থেকে তেলাপিয়া প্রবর্তন করা হয়। ইউনিসেফ ও মৎস্য অধিদপ্তর যৌথ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে আরেক জাতের তেলাপিয়া (O. niloticus) আমদানি করে। এছাড়া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থাইল্যান্ড থেকে আরও কিছু তেলাপিয়া আমদানি করেছিল ১৯৮৭ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালগোয়া উপসাগর থেকে সোমালিল্যান্ডের পশ্চিমে শেবালি নদী পর্যন্ত আফ্রিকার পূর্ব সমুদ্র উপকূল বরাবর বিস্তৃত নদীসমূহ তেলাপিয়ার আদি আবাস। বাংলাদেশসহ সাভা, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভারত, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে তেলাপিয়ার স্থানান্তর ঘটেছে। এটি স্বাদুপানির ও স্বল্পলবণাক্ত পানির পুকুরে চাষ করা যায়।
তেলাপিয়াকে উদ্ভিদভোজী বলা হয়। পোনা পর্যায়ে এরা কেবল ডায়াটম ও অন্যান্য প্লাঙ্কটনজাতীয় জীব খেয়ে থাকে। পরে অপ্রাপ্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক তেলাপিয়া সব ধরনের খাদ্যে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। পুকুরে চাষের ক্ষেত্রে এরা ধান ও গমের ভুসি, ময়দা, ক্ষুদিপানা, খৈল ইত্যাদি খায়। পুকুরে তেলাপিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অগভীর ও ছোট পুকুর এদের চাষের জন্য আরও ভাল। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মাছটি প্রসিদ্ধ। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে ওজন দাঁড়ায় ২০০-৩৫০ গ্রাম। প্রজনন ও ডিম পাড়ানোর জন্য বিশেষ কৌশল দরকার হয় না।
ফিলিপাইন থেকে ১৯৯৪ সালে খামারে জন্মানো বংশগতভাবে উন্নত তেলাপিয়া (Genetically Improved Farmed Tilapia/GIFT) বাংলাদেশে আনা হয়। উন্নত তেলাপিয়া হলো O. niloticus প্রজাতির একটি নতুন জাত যা নীল নদের তেলাপিয়ার আটটি বিভিন্ন অমিশ্র জাতের কয়েক প্রজন্মের নির্বাচন মাধ্যমে উৎপন্ন।
সাধারণ কার্প বাংলাদেশে ‘কার্পিও’ নামে পরিচিত। এদেশে এ মাছের প্রবর্তনের সময়কাল সঠিকভাবে জানা না গেলেও ১৯৬০ সালে প্রবর্তিত হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। প্রমাণ পাওয়া যায় যে মাছটি এদেশে এসেছে ভারত থেকে। সেখানে এটি ১৯৩৯ সালে প্রবর্তিত হয়। সাধারণ কার্পের আদি বাসস্থান এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে চীনে। বর্তমানে এটি উষ্ণমন্ডল ও আধা-উষ্ণমন্ডলসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের অনেকগুলি জাত, তন্মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় Scale carp (Cyprinus carpio var.communis), Mirror carp (C. carpio var. specularies) এবং Leather carp (C. carpio var. nudus)।
বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থল ও পরিবেশে এ মাছের খাপ খাওয়ানোর অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এরা বহুবিধ খাবার গ্রহণ করে। অল্প বয়সে এরা জু-প্লাঙ্কটন খায় এবং পরবর্তী জীবনে খায় প্রধানত পানির নিচের অমেরুদন্ডী প্রাণী। এছাড়া শৈবাল, পচনশীল উদ্ভিজ্জ ইত্যাদিও খেয়ে থাকে। এই কার্প পুকুরের পরিবেশে নানা ধরনের তৈরি সম্পূরক খাবার খেতেও অভ্যস্ত। স্বাভাবিক প্রজননে এদের আঠালো ডিম আটকে থাকার জন্য পুকুরে জলজ উদ্ভিদ থাকা প্রয়োজন। অবশ্য, হ্যাচারিতেও প্রজনন ঘটানো যায়। বাংলাদেশের পরিবেশে সাধারণ কার্প ছয় মাসে প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং বছরে শীতে ও গ্রীষ্মে দুবার পোনা ছাড়ে।
সিলভার কার্প ১৯৬৯ সালে হংকং থেকে আনা হয়। সিলভার কার্পের লক্ষণীয় বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কার্প প্রজাতির সঙ্গে সহাবস্থানের ক্ষমতার কারণে বিদেশী মাছের মধ্যে এটি বাস্ত্তসংস্থানবিদ ও মৎস্য ব্যবস্থাপকদের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। দক্ষিণ ও মধ্য চীনের এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমুর বেসিন (Amur Basin) নদীগুলি সিলভার কার্পের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। সম্প্রতি বহু দেশে এই মাছটির চাষ চলছে। বাংলাদেশে পুকুরে বিভিন্ন ধরনের মাছ একত্রে চাষ করার ক্ষেত্রে (polyculture) এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হয়ে উঠেছে। সিলভার কার্প এপ্রিল-জুলাই মাসে প্রাকৃতিক আবাসস্থলের স্রোত ধারায় স্বাভাবিকভাবে প্রজনন করে থাকে।
গ্রাস কার্প চীনের সমভূমির নদীসমূহ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমুর নদীর মধ্য ও শেষ অংশের শাখাসমূহ গ্রাস কার্পের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে হংকং থেকে গ্রাস কার্পের প্রথম চালান আসে। বাংলাদেশে জলজ আগাছার নিয়ন্ত্রণে এই মাছটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। জলজ উদ্ভিদ চিবানোর জন্য এদের গলবিলে বিশেষ ধরনের দাঁত থাকে। জানা গেছে যে, Najas, Hydrilla, Wolfia, Lemna, Azolla, Salvinia ইত্যাদি আগাছা গ্রাস কার্পের সাহায্যে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে এরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে। গ্রাস কার্প বর্ষা মৌসুমে স্রোতপ্রবাহে প্রজনন সম্পন্ন করে এবং সাধারণত আবদ্ধ পরিবেশে পোনা ছাড়ে না। হ্যাচারিতে প্রজননের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। কৃত্রিম চাষে এদের দেহের বৃদ্ধি পুকুরে মাছের সংখ্যা ও প্রদত্ত খাবারের ওপর নির্ভরশীল। এই কার্প দেহের ওজনের ৪০-৭০% ঘাস খেয়ে থাকে। মিশ্রচাষে ছয় মাসে এদের ওজন হয় ৭৫০ গ্রাম থেকে ১০০০ গ্রাম পর্যন্ত।
ব্ল্যাক কার্প ১৯৮৩ সালে চীন থেকে প্রথম আমদানি করা হয়। এটি প্রধানত শামুক খায় বলে এদের অনেক সময় শামুক কার্পও বলা হয়।
বিগহেড কার্প ১৯৮১ সালে নেপাল থেকে আনা হয়। চীনের নদীগুলি এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। আবদ্ধ পরিবেশে বিগহেড প্রজনন সম্পন্ন করে না। সাধারণত স্ত্রী মাছ ৩-৫ বছরে ও পুরুষ মাছ প্রায় এক বছরে প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
রাজপুঁটি (Rajputi, Puntius gonionotus) রাজপুঁটি বা থাইপুঁটি ১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে প্রথম আনা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীসমূহ এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। বাংলাদেশের স্থানীয় সরপুঁটির (Puntius sarana) সঙ্গে এদের চেহারার মিল রয়েছে। রাজপুঁটি দৈর্ঘ্যে ২০ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। এরা আবদ্ধ পরিবেশে ডিম ছাড়ে না। প্রাকৃতিক পরিবেশে নদীপ্রবাহে বা খালের পানির স্রোতে প্রজনন করে। বাংলাদেশের পরিবেশে রাজপুঁটি এক বছরে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। চাষের জন্য অগভীর, ছোট জলাশয় ও খাদ উপযুক্ত। অন্যান্য প্রজাতির মাছের সঙ্গে এর মিশ্রচাষও করা যায়।
আফ্রিকান মাগুর (African magur, Clarias gariepinus) আফ্রিকা আদি আবাস হলেও থাইল্যান্ড থেকে এ মাগুর প্রথম বাংলাদেশে আনা হয় ১৯৮৯ সালে। এ মাছ খুব কষ্টসহিষ্ণু এবং পানিতে 0.02ppm মাত্রার স্বল্প অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। আফ্রিকান মাগুর সর্বভুক। কম বয়সে শিকারের অত্যধিক প্রবণতা থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এটি এক বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। পুকুরে এদের বৃদ্ধি বহুলাংশে নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার ওপর। ব্যাপক (extensive) ব্যবস্থাপনায় এদের ৮-১০ মাসের মধ্যেই বাজারজাত করার মতো বড় করা যায়। তবে পুকুরের আধানিবিড় (semi-intensive) ব্যবস্থাপনায় গ্রহণ উপযোগী মাছ ৩-৪ মাসের জন্য পালন করা হয়। এটি ওজনে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
থাই পাঙ্গাশ (Thai pangus, Pangasius sutchi) ১৯৮৯ সালে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাদুপানি এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। মাছটি পানির লবণাক্ততা, অম্লতা (pH) ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রার ওঠানামা এবং এমনকি কিছু পরিমাণ দূষণও সহ্য করতে পারে। স্বভাবে সর্বভুক এবং খায় ক্রাসটেসিয়ান ও শামুকজাতীয় প্রাণী, মাছ, উদ্ভিদবর্জ্য ইত্যাদি।
মহাশোল (Mahseer, Tor tor) স্থানীয় মাছ এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও দিনাজপুরের নদী অববাহিকায় ছড়িয়ে রয়েছে; তা সত্ত্বেও নেপাল থেকে এই মাছের একটি চালান এনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানির স্টেশনে প্রতিপালন করা হচ্ছে।
অন্যান্য বিদেশী মাছের মধ্যে ১৯৭৯ সালে আনা মিল্কফিশ (Milkfish, Chanos chanos) উল্লেখযোগ্য। প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের উপকূলের দূরবর্তী উষ্ণ পানি মিল্কফিশের আবাসস্থল। এ মাছ বঙ্গোপসাগরেও রয়েছে বলে জানা যায়। চাষের জন্য স্বল্পলোনাপানিই অধিক উপযোগী। কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী থাইল্যান্ড থেকে পোনা আমদানি করে সাতক্ষীরা এলাকায় এ মাছ চাষ করছেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটও এর সামুদ্রিক কেন্দ্রে পালন ও প্রজননের জন্য ১৯৯৮ সালে মিল্কফিশের পোনা আমদানি করে।
[মোঃ শাহাদৎ আলী]
আরও দেখুন কার্পমাছ।