মিশ্রচাষ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

মিশ্রচাষ  একই খামারে ফসল, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মৎস্য প্রভৃতি উৎপাদনের কৃষি ব্যবস্থা। মিশ্রচাষ ব্যবস্থায় চাষ পদ্ধতির ঐ ধরনকে কাজে লাগানো হয় যাতে ফসল, গবাদি পশু ও বৃক্ষ উৎপাদন অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি শ্রমঘন মিশ্রচাষ ব্যবস্থা অনুশীলনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এক খন্ড জমির উপর সর্বোচ্চ পুনরাবর্তন নীতির ভিত্তিতে ফসল, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। অধিকাংশ মিশ্রখামারে রয়েছে একাধিক উদ্যোগ এবং যেগুলিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে ফসল, গবাদি পশু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, মৎস্য; কখনও ফসল, গবাদি পশু, মহিষ, হাঁস-মুরগি; কখনওবা গবাদি পশু, ছাগল, হাঁস-মুরগি; আবার কখনও ফসল মৎস্য ইত্যাদির উৎপাদন ব্যবস্থা। দুই বা ততোধিক ফসল যুগপৎ একই জমিতে ফলানোর পদ্ধতিকেও মিশ্রচাষ বলা হয়।

এক বা একাধিক ফসল এবং ফসলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া, অন্যান্য গৃহস্থালি উদ্যোগ এবং প্রাকৃতিক, জৈবিক ও আর্থ-সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সকল উপাদানের সমন্বয়ে কৃষি ব্যবস্থা প্রণালীতে চাষ পদ্ধতি একটি উপ-পদ্ধতি। চাষ পদ্ধতির ধরন হচ্ছে এক খন্ড জমির উপর বিশেষ এবং সাময়িকভাবে ফসল একত্রে লাগানো এবং এগুলি উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত ব্যবস্থাপনা কার্য। দেশের কৃষি ব্যবস্থা হচ্ছে জটিল, শ্রমঘন এবং প্রযুক্তিগতভাবে নিম্নমানের এবং সম্পদের দিক দিয়ে রয়েছে স্বল্পতা। অধিকন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানে কৃষি প্রতিবেশগত অবস্থা জটিল। এই দেশে রয়েছে কতকগুলি স্বতন্ত্র প্রকারের জমি। এমনকি একটি গ্রামে কমপক্ষে তিনটি প্রধান ধরনের জমি বিদ্যমান, যেগুলি ফসল চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি নির্ধারণ করে এবং জমির ব্যবহারকে জটিল করে তোলে। অধিকাংশ কৃষক এমন ধরনের চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে যাতে পর্যায়ক্রমে ফসল চাষ পদ্ধতি, মিশ্রচাষ পদ্ধতি এবং বদলি বা সাথী ফসল চাষ পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকে। মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে দুই অথবা ততোধিক ফসল যুগপৎ মিশ্রিত অবস্থায় একই জমিতে উৎপন্ন করার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকে। দুই প্রকারের মিশ্রচাষ পদ্ধতি রয়েছে, যথা ১. মিশ্র মধ্যবর্তী ফসল চাষ পদ্ধতি, যেখানে দুই বা ততোধিক ফসল যুগপৎ মিশ্রিত অবস্থায় একই জমিতে ফলানো হয় স্পষ্টভাবে সারিবদ্ধ না করেই এবং ২. মিশ্র সারিবদ্ধ চাষ পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে স্পষ্ট সারিতে বিন্যস্তভাবে দুই বা ততোধিক ফসল যুগপৎ মিশ্রভাবে একই জমির উপর চাষ করা হয়।

মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে যেসব সুবিধার উল্লেখ করা হয় সেগুলি হলো: ১. বিভিন্ন শস্য মৌসুমে অধিকতর স্থিতিসম্পন্ন উৎপাদন বা ফলন; ২. উৎপন্ন দ্রব্য সম্পদের অধিকতর সুষ্ঠু ব্যবহার; ৩. আগাছা, কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; ৪. একটি ফসল যাতে অন্য ফসলকে প্রাকৃতিক সাহায্য প্রদান করে; ৫. একটি ফসল অন্য ফসলকে আশ্রয় প্রদান করে; ৬. নিরবচ্ছিন্নভাবে ভূমির উপরিভাগে পাতার আচ্ছাদন দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং ৭. সীমিত সংগতিসম্পন্ন ক্ষুদ্র কৃষকগণের এই ব্যবস্থা অনুশীলনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা। তবে পাশাপাশি এই পদ্ধতির কিছু কিছু অসুবিধাও রয়েছে।


মসুর ও তিসির মিশ্রচাষ


বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ফসল চাষ পদ্ধতি গবেষণার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে মিশ্র এবং বদলি বা সাথী ফসল চাষ পদ্ধতির চর্চা সচরাচর করা হয়। বলা হয়েছে যে, গম এবং সরিষা অথবা গম এবং মসুরের (ডাল) মিশ্রচাষ পদ্ধতির চেয়ে গম এবং মটর কলাইয়ের মিশ্রচাষ পদ্ধতি অধিকতর ভাল। একত্রীকৃত বীজের হারের মধ্যে গম এবং মটর কলাই ও গম এবং সরিষার ক্ষেত্রে ৫০:৫০ অনুপাত অধিকতর ভালো ফলদায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু গম এবং মসুরের বেলায় ৭৫:২৫ অনুপাত অপেক্ষাকৃত ভাল মনে হয়।

পার্বত্য অঞ্চলে  জুমচাষ মিশ্রচাষ পদ্ধতির একটি প্রতীকী দৃষ্টান্ত। বিধিসম্মত পন্থা ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল চাষ পদ্ধতি গবেষণার কাজটি কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণসহ একটি জাতীয় সমন্বিত ফসল চাষ প্রণালীর কর্মসূচি সংগঠিত ও সমন্বয় সাধন করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ফসল চাষ পদ্ধতির সঠিক ধরনের রূপরেখা নিরূপণের জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ একটি জাতীয় সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা প্রণালী গবেষণা কর্মসূচির কাজ হাতে নিয়েছে। প্রস্তাবিত কিছু কিছু মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা/চাষ পদ্ধতির তালিকা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো: গভীর পানির আমন ধান + আউশ-রবি ফসল (ঐতিহ্যগত পদ্ধতি অনুশীলন); আউশ - সরিষা + মসুর; ভুট্টা + মুগ (ডাল) - গম; আখ + সরিষা; আখ + আলু, ঈশ্বরদি, খালিকাপুর এবং অনুরূপ অঞ্চলের জন্য; আখ + আলু; ব্ল্যাক গোর্ড - আলু + আদা + পয়েন্টেড গোর্ড (পটল), ঠাকুরগাঁও এবং অনুরূপ অঞ্চলের জন্য; ব্ল্যাক গ্রাম (সবুজ সার) - আলু + রসুন + পয়েন্টেড গোর্ড (পটল), রংপুর এবং অনুরূপ অঞ্চলের জন্য; সবুজ সার (ধইঞ্চা) - রোপা আমন - মটর কলাই + তিসি, রাজশাহী বরেন্দ্র এলাকা এবং অনুরূপ অঞ্চলের জন্য; এবং মুগ (ডাল) + রোপা আমন - গম, ময়মনসিংহ এবং অনুরূপ অঞ্চলের জন্য।

দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতিতে লতাজাতীয় সবজি উৎপন্ন করা যেতে পারে। দেশের নিম্নাঞ্চলে ধানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে মৎস্য চাষ এবং বছরব্যাপী পানির আধার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছের সঙ্গে লেয়ার মুরগির চাষ এবং মাছের সঙ্গে ব্রয়লার মুরগি পালন করা যেতে পারে। মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে সঠিকভাবে ফসল একত্রীকরণ এবং উপযুক্ত কৃষিবিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুশীলন করা হলে কেবল বর্ধিত পরিমাণ শস্য উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে মুনাফাই নিশ্চিত করবে না, প্রচুর পরিমাণে গবাদি পশুর খাদ্যের প্রাপ্যতাও নিশ্চিত হবে এবং মৃত্তিকার উর্বরতাও রক্ষা পাবে।  [মোঃ সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন কৃষি; খামার ব্যবস্থা; ফসল।