লং, রেভারেন্ড জেমস
লং, রেভারেন্ড জেমস (১৮১৪-১৮৮৭) চার্চ মিশনারি সোসাইটির একজন যাজক। তিনি প্রাচ্যবিদ ও সক্রিয় মানবতাবাদী হিসেবে বাংলা ও ইংল্যান্ডে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী লং প্রথম জীবনে কিছুকাল রাশিয়ায় বসবাস করেন। ঊনিশ শতকে ধর্মান্তরণের কাজে বাংলায় আগত মিশনারিদের মধ্যে জেমস লং ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটির লন্ডনস্থ আইলিংটন কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের গির্জার ‘ডিকন’ এবং পরের বছরই যাজক পদে অভিষিক্ত হন। লং ১৮৩৯ সালে যাজকরূপে কলকাতায় আসেন। কলকাতার দক্ষিণে ঠাকুরপুকুর গ্রাম ছিল তাঁর নির্ধারিত কর্মক্ষেত্র। সেখান থেকে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
জেমস লং বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসিসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং অচিরেই একজন প্রাচ্যবিদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত (১৮৪৩) তাঁর Comparative Philology শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ ভারতীয় ভাষা অধ্যয়নে নিয়োজিত সমকালীন বিশ্বের অন্যান্য ভাষাবিদের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করে। বাংলার অধিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার সময় লং স্থানীয় লোকদের মধ্যে প্রবাদ-প্রবচনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করেন এবং উপলব্ধি করেন যে, তাদের ব্যবহূত প্রবাদ-প্রবচন গভীর অর্থবোধক এবং প্রকাশভঙ্গিতে খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি বাংলার সব অঞ্চল থেকে প্রবাদবাক্য সংগ্রহ করে টীকা-টিপ্পনীসহ সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর সংকলিত Bengali Proverbs গ্রন্থটি (১৮৫১) বিকাশমান বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পরবর্তী দুই দশক তিনি বাংলা প্রবাদবাক্য ও বাংলা লোকসাহিত্য বিষয়ে আরও অধ্যয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বাংলার সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নকালে লং A catalogue of Bengali Newspapers and Periodicals from 1818-1855 এবং Descriptive Catalogue of Vernacular Books and Pamphlets (১৮৬৫) প্রকাশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ধাতুমালা, দৃষ্টান্তরত্ন, জীব-রহস্য, প্রাচ্য প্রবচন, পুরাতন কলকাতা, Selections from Unpublished Records of Government, Report on the Native Press of Bengal, Early Bengali Literature and Newspapers.
একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে রেভারেন্ড লং উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশ নীলকরদের কার্যকলাপ গ্রামীণ বাংলায় ধর্মান্তরণের অগ্রগতির পরিপন্থী। তিনি ইন্ডিগো কমিশনে এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, জনগণ প্রায়শ তাঁর প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে, যেমন, ‘তুমি তোমার দেশবাসী নীলকরদের অত্যাচার হ্রাস করতে বলোনা কেন, যাও তাদের কাছেই প্রথম ধর্মপ্রচার কর’।
গ্রামীণ জনগণের সাথে জেমস লং-এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে তাঁর এ বিশ্বাস জন্মে যে, ব্রিটিশ বণিক গোষ্ঠী এবং এমনকি সরকারও জনসাধারণ, বিশেষ করে নীলচাষিদের প্রতি অন্যায় ও নিপীড়নমূলক আচরণ করে থাকে। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রথমে বেনামে প্রকাশিত নীলদর্পন নামক নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলকরদের অত্যাচারের যে চিত্র তুলে ধরেন, তার সাথে তিনি সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। লং স্বরচিত ভূমিকাসহ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ঐ অনুবাদকর্মে প্রকাশিত নীলকরদের অত্যাচারের ধরন প্রশাসনকে এতই ক্ষুব্ধ করে যে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সংবাদপত্রে অনুবাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে ক্রোধোন্মত্ত প্রচারণা শুরু হয়। ইংলিশম্যান পত্রিকা ও কয়েকজন নীলকর লং ও প্রকাশকের (C.H. Manuel & Co) বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু করে। সংক্ষিপ্ত বিচারে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত জুরি বোর্ড লং ও তাঁর প্রকাশককে দোষী সাব্যস্ত করে রায় প্রদান করে। তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ নামক জনৈক বুদ্ধিজীবী ও জমিদার তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে জরিমানার টাকা জমা দেন। কিন্তু লং-কে ১৮৬১ সালের জুলাই মাসে কারাদন্ড ভোগ করতে হয়। তাঁর বন্দিদশায় এবং মুক্তির সময় অসংখ্য গণজমায়েত, স্মারকলিপি, সমবেদনাজ্ঞাপক চিঠি এবং তাঁর দর্শন লাভের জন্য লোকের ভিড় থেকে প্রমাণিত হয় যে, লং বাংলার জনগণের তাৎক্ষণিক নায়কে পরিণত হয়েছেন।
লং কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং Questions of Natural History, Life of Mahomed, Bengali Etymology সহ বাংলায় বেশ কয়েকটি পাঠ্যবই সংকলন করেন। বেথুন সোসাইটি, বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন ও কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। বাংলার সমাজ সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি এবং উপনিবেশের জনগণের ওপর ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব সম্পর্কে তাঁর দুর্ভাবনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তিনি ‘Five Hundred Questions on the Subjects Requiring Investigation in the Social Condition of the Natives of Bengal’ শিরোনামে এক সুদীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাঁর এই প্রতিবেদন কলকাতার বেথুন সোসাইটি (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫১), গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি (১৮৬৬) সহ ভারত ও ব্রিটেনের বহু বিদ্বৎ সংস্থার কার্যবিবরণীতে প্রকাশিত হয়। এছাড়া উপনিবেশিক সরকারের অপশাসন সম্পর্কে ব্রিটেন ও ভারতে তিনি জনসাধারণের কল্পনাকে কতটা অধিকার করেছিলেন তার প্রকাশ ঘটেছে একটি পৃথক সংস্করণ হিসেবে তাঁর এই প্রতিবেদনটির বহু পুনর্মুদ্রণের মাধ্যমে।
১৮৭২ সালে জেমস লং চিরতরে কলকাতা ত্যাগ করেন এবং জীবনের অবশিষ্ট কাল লন্ডনে অতিবাহিত করেন। ১৮৮৭ সালের ২৩ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর সকল জীবনালেখ্যে তাঁকে একজন বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ ও মানবতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি Long Lectureship on Oriental Religion নামে এক বৃত্তি প্রবর্তন করে যান, যা এখনও চালু রয়েছে। [নূরুল হোসেন চৌধুরী]