বীরভনপুর

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বীরভনপুর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের সন্নিকটে দামোদর নদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি মাইক্রোলিথিক (ক্ষুদ্রাকৃতির প্রস্তর হাতিয়ার) প্রত্নস্থল। প্রত্নস্থলটি বীরভনপুর গ্রামের সীমানার মধ্যে চিহ্নিত। ১৯৫০ এর দশকের প্রথমদিকে স্থানীয় জমিদার এ.কে মুখার্জী প্রত্নস্থলটি আবিষ্কার করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের (পরবর্তীকালে এ.এস.আই নামে পরিচিত) পূর্বাঞ্চলীয় সার্কেলের তদানীন্তন সুপারিনটেন্ডেন্ট বি.বি লাল প্রত্নস্থল পরিদর্শন করেন এবং ১৯৫৪ সালে কিছুটা খনন কার্য পরিচালনা করেন। এ খননকার্যের ফলে ক্ষুদ্রাকৃতির পাথরের হাতিয়ারসমূহের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। প্রাপ্ত ক্ষুদ্রাকৃতির পাথরের হাতিয়ারসমূহের মধ্যে কোন মৃৎপাত্র পাওয়া যায় নি।

আনুমানিক ২.৫৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত প্রত্নস্থলটির দক্ষিণ দিক দামোদর নদ দ্বারা বেষ্টিত। অঞ্চলটি দামোদর নদের সবচেয়ে নতুন দুটি চত্বরে অবস্থিত। খননকারীরা বিশ্বাস করেন যে, অঞ্চলের উত্তরে রয়েছে আরও প্রাচীনতর চত্বর। সুতরাং সাময়িকভাবে চত্বরগুলি টি.এন এবং টি.এন-১ সংখ্যায় চিহ্নিত করা হয়। নদীর তলা সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৮.৮৩ মিটার উপরে অবস্থিত। টি.এন চত্বরটি সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৭.০৬ - ৬৮.৪৪ মিটার এবং টি.এন-১ আরও উপরে এম.এস.এল-এর ৮২ মিটার উপরে অবস্থিত। চত্বর শেষ হয়েছে সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০.১০ মিটার উপরে। একই ধারার বেলে মাটির চত্বরটি রেলপথের সংযোগস্থল ও পরিখার উপরে ০.৭৫ মিটার পুরু ছিল। এর পরে ছিল বহুবর্ণের পলিযুক্ত বালি যা নিম্নস্থ সাদা বেলে পাথরের মতোই ছিল। এখানেই মাইক্রোলিথিক কারখানা পাওয়া গেছে এবং তা উপরাংশের প্রায় ০.৪৬ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

প্রথম পরিখাটি টি.এন চত্বরে স্থাপন করা হয়েছিল এবং এর নামকরণ করা হয়েছিল বি.বি.পি-১। এ পরিখাটি ১৯৫৪ সালে খনন করা হয়। আরও কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৫৭ সালে আর একটি পরিখা টি.এন-১ চত্বরে খনন করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় বি.বি.পি-২। টি.এন চত্বরটির গভীরতা ১২ ফুট। এ পরিখায় ৫টি স্তর চিহ্নিত করা হয়। তিন নম্বর স্তরটি ছিল সমতল ভূমির উপরিভাগ এবং এখানেই মাইক্রোলিথিক মানুষ তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। দুই নম্বর স্তরে প্রধানত কোয়ার্টজ ও মূল্যবান আকরিক লোহার মোটা দানা মিশ্রিত মাটি বিদ্যমান ছিল। এ স্তরের পুরুত্ব ২০.৩০ সেমি থেকে ০.৩০ মি পর্যন্ত পরিবর্তিত হতো। এ স্তরের ০.১৫ মি থেকে ০.২০ মি পর্যন্ত নিম্নাংশে অধিকাংশ ক্ষুদ্রাকৃতির প্রস্তর হাতিয়ার পাওয়া গেছে।

বি.বি.পি-২ পরিখাটি বি.বি.পি-১-এর একশ গজ উত্তরে অবস্থিত। বি.বি.পি-২-এর পূর্ব দিকে আর একটি পরিখা খনন করা হয়েছে এবং এর নাম দেওয়া হয় বি.বি.পি-২ সম্প্রসারিত পূর্বাংশ। এ দুটি পরিখার গড় গভীরতা ১.৮৩ মিটার। টি.এন-২-র পূর্বদিকে সংযোজিত অংশে ১.৮৩ মিটার হতে ০.৯০ মিটার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ একটি এলাকায় খনন পরিচালনা করা হয়েছিল এবং এর মোট গভীরতা ছিল ৩.৭০ মিটার। এ পরিখাকে পাঁচটি স্তরে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পঞ্চম স্তরটি লাল মাটির নুড়ি সমেত পলি মাটি দ্বারা গঠিত ছিল। এর উপরিভাগ তরঙ্গায়িত ছিল এবং এটি মাইক্রোলিথিক মানুষের দখলে ছিল। চতুর্থ স্তরটিতে লালমাটির নুড়িসহ লালাভ পলি মাটি বিদ্যমান ছিল। টি.এন-২ পরিখায় এটি ছিল হাতিয়ার সমৃদ্ধ স্তর। মৃৎপাত্র বর্জিত মাইক্রোলিথিক স্তর এভাবে টি.এন পরিখায় প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহ নিশ্চিত করে। যেখানেই টি.এন-১ পরিখায় হাতিয়ার-সমৃদ্ধ স্তর প্রকাশ পেয়ে মাটি ক্ষয় হয়েছে, সেখানেই মাইক্রোলিথিক নিদর্শনসমূহ গুচ্ছ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

বহির্গাত্র ও পরিখা থেকে প্রাপ্ত মূল পাথরের, চিলতে পাথরের এবং প্রস্ত্ততকৃত হাতিয়ারের নিদর্শনাদির ওপর ভিত্তি করে খননকারীরা বলেন যে, এটি সম্ভবত একটি শিল্প-কারখানা ছিল  যেখানে মাইক্রোলিথিক বা ক্ষুদ্রাকৃতির পাথুরে হাতিয়ার উৎপাদিত হতো। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হতো কোয়ার্টজ, শিলা-স্ফটিক, মূল্যবান প্রস্তর বিশেষ, কোয়ার্টজাইট, ঘোরবর্ণ আগ্নেয়শিলা বিশেষ ও কাঠের জীবাশ্ম ইত্যাদি। অন্যান্য কাঁচামালসমূহের মধ্যে কোয়ার্টজ সংখ্যায় অধিক (৬৮.৭%)। হাতিয়ার তৈরি করতে কাঠের জীবাশ্মের ব্যবহার (সমগ্র মিশ্রণের ১%) বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দেখা যায় যে, কাঠের জীবাশ্ম ব্যতীত অন্যান্য কাঁচামাল সহজলভ্য ছিল। বিঁধনযন্ত্রাদি তৈরি করার জন্য বেশি ব্যবহূত হতো শিলা-স্ফটিক। ধরনগত বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, বীরভনপুরের শিল্পে মূলত ছিল অজ্যামিতিক আকারের প্রাধান্য। বহিরাবরণ ও উৎখনন থেকে বিভিন্ন আকারের ও বিভিন্ন প্রযুক্তিতে নির্মিত কঠিন শিলা, পাত, ছুরির ফলা, অর্ধচন্দ্রাকৃতি হাতিয়ার, সূচাগ্র হাতিয়ার, বিভিন্ন রকমের হাতিয়ারের অংশসমূহ পাওয়া গেছে।

খননকার্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো বহিরাবরণের নিচে গভীরতায় ১.৩৭ মিটার এবং ৪৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি গর্ত থেকে একটি কামারের নেহাই-এর আবিষ্কার। ১.২ মি গভীরে ১০টি গর্তের আবিষ্কার কুঁড়েঘরের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

বীরভনপুরের মাইক্রোলিথিক প্রত্নস্থলের কাল হলোসিনিক যুগের প্রথমভাগ বলে নিরূপিত হয়েছে। হাতিয়ারাদির ধরনগত শ্রেণীবিভাজন ও ভারতের এরূপ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনামূলক গবেষণার ভিত্তিতে বীরভনপুর প্রত্নস্থলের সম্ভাব্য কাল চার হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে মনে করা হয়। জ্যামিতিক নকশা ও মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি এর ইঙ্গিত বহন করে। ভূতাত্ত্বিক তথ্য থেকে ধারণা করা যায় যে, সম্ভবত প্লাইস্টোসিন যুগের প্লাবনকালের শেষের দিকে মাইক্রোলিথিক মানুষ এ চত্বর অধিকার করেছিল। সুতরাং উৎখননকারীরা মনে করেন যে, মাইক্রোলিথিক যুগ হলোসিনিক যুগের প্রথম থেকে মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত। [সমীর কে. মুখার্জী এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়]

গ্রন্থপঞ্জি  BB Lal, Birbhanpur, A Microlithic Site In the Damodar Valley, West Bengal, Ancient India, 14, 1958.