মধুসূদন সরস্বতী
মধুসূদন সরস্বতী (১৫২৫-১৬৩২) সংস্কৃত পন্ডিত, দার্শনিক। ফরিদপুর জেলার তৎকালীন কোটালিপাড়া পরগনার অন্তর্গত ঊনশিয়া একটি গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা প্রমোদ পুরন্দর আচার্যও ছিলেন একজন সংস্কৃত পন্ডিত।
মধুসূদনের প্রকৃত নাম ছিল কমলজনয়ন। প্রথম জীবনে সংসার ত্যাগ করে তিনি গুরু বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নিকট সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তখন তাঁর নাম হয় মধুসূদন। শৈশবে তিনি পিতার নিকট শিক্ষালাভ করেন। পরে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি নবদ্বীপ যান। সেখানে বিখ্যাত দার্শনিক হরিরাম তর্কবাগীশ ও মথুরানাথ তর্কবাগীশ ছিলেন তাঁর শিক্ষক, গদাধর চক্রবর্তী সতীর্থ এবং পরবর্তীতে পুরুষোত্তম সরস্বতী তাঁর ছাত্র।
মধুসূদন বেশ কিছুদিন কাশীতে ছিলেন। সেখানে বিভিন্ন পন্ডিতের নিকট তিনি বেদান্ত অধ্যয়ন করেন। এসময় হিন্দি রামায়ণ রামচরিতমানস প্রণেতা তুলসীদাসের সঙ্গে তাঁর সখ্য হয় এবং শাস্ত্রালোচনায় তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে মধুসূদন একটি শ্লোকও রচনা করেন। পরবর্তীকালে মধুসূদনের পান্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) তাঁকে সম্মানিত করেন। দিল্লির রাজসভায় প্রভাব থাকার কারণে মধুসূদন আত্মরক্ষার জন্য সন্ন্যাসীদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি লাভে সমর্থ হন। তিনি শঙ্করাচার্যসৃষ্ট সন্ন্যাসী সম্প্রদায়েরও সংস্কার সাধন করেন।
মধুসূদনের নামে প্রচলিত সর্বমোট একুশখানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেসবের মধ্যে উনিশখানা নিশ্চিত তাঁর রচনা, বাকি দুটির রচয়িতা তিনি কিনা তা নিশ্চিত নয়। তাঁর গ্রন্থসমূহের অধিকাংশই (১২ খানা) দর্শনবিষয়ক; অন্যগুলি কাব্য, নাটক এবং অন্যবিধ রচনা। দর্শনবিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে কয়েকটি তাঁর মৌলিক রচনা এবং বাকিগুলি টীকাগ্রন্থ। দর্শনবিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ অদ্বৈতসিদ্ধি। এতে তিনি শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবেদান্তকে সমর্থন করে ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। বেদান্তবিমুখ বলে বাঙালির যে অপবাদ ছিল, মধুসূদনের দর্শনগ্রন্থসমূহের দ্বারা, বিশেষত অদ্বৈতসিদ্ধির দ্বারা তা অপনোদিত হয়। তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধি গ্রন্থটি সে সময় এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, এর ওপর অনেক টীকাগ্রন্থ রচিত হয়। তাঁর গীতাভাষ্য ভগবদ্গীতাগূঢ়ার্থদীপিকাও বাঙালির এক গৌরবের বিষয়। তাঁর অপর তিনটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ভক্তিরসায়ন, সিদ্ধান্তবিন্দু ও মহিম্নঃস্তোত্র। মধুসূদন তাঁর পান্ডিত্য, বিশেষত অদ্বৈতবেদান্তে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সর্বভারতীয় যে সম্মান অর্জন করেছিলেন, তাতে পূর্ববাংলা তথা সমগ্র বাংলার গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
শেষজীবনে মধুসূদন কাশী থেকে নবদ্বীপ ফিরে এলে অদ্বৈতবাদের অদ্বিতীয় পন্ডিত হিসেবে তাঁকে সম্বর্ধিত করা হয়। এর কিছুকাল পরে মায়াপুরীতে সমাধিস্থ অবস্থায় তিনি পরলোক গমন করেন। [দুলাল ভৌমিক]