মানসিংহ, রাজা
মানসিংহ, রাজা রাজা ভগবান দাসের পালক পুত্র। আম্বরে জন্মগ্রহণকারী মির্জা রাজারূপে পরিচিত মানসিংকে সম্রাট আকবর ফরজন্দ (পুত্র) খেতাবে ভূষিত করেন। ভগবান দাস পাঞ্জাবের সুবাহদার নিযুক্ত হলে মানসিংহ সিন্ধু নদের তীরবর্তী জেলাগুলি নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রদেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে কাবুলে পাঠানো হয় এবং ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিহারের সুবাহদার নিযুক্ত হন। তখন পর্যন্ত কুনওয়ার রূপে পরিচিত মানসিংহকে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজা’ উপাধি এবং পাঁচ হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে বাংলার সুবাহদার নিয়োগ করা হয়। ১৫৯৪-১৫৯৮, ১৬০১-১৬০৫ এবং ১৬০৫-১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিন মেয়াদে সুবাহদারের দায়িত্ব পালন করেন।
আফগান দলপতি এবং ঈসা খানের নেতৃত্বাধীন ভূঁইয়াদের দমন করা ছিল বাংলায় রাজা মানসিংহের প্রধান কাজ। তান্ডা থেকে প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি চারদিকে কয়েকটি পরীক্ষামূলক অভিযান পরিচালনা করেন এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর তান্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর করেন। নতুন রাজধানীর তিনি নামকরণ করেন আকবরনগর। মানসিংহের পুত্র হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে এক পরীক্ষামূলক অভিযানে ঈসা খানের মিত্র কেদার রায়ের নিকট থেকে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল ভূষণা দুর্গ দখল করা হয়। ঈসা খানের নিকট থেকে ভাটি জয়ের উদ্দেশ্যে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর মানসিংহ নিজেই নতুন রাজধানী থেকে যাত্রা করেন। মানসিংহ নিকটবর্তী হলে ঈসা খান ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে পশ্চাদপসরণ করেন। মানসিংহ শেরপুর মোর্চায় (বগুড়া জেলায়) শিবির স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই স্থানের নামকরণ করেন সেলিমনগর এবং বর্ষাকালটা তিনি সেখানেই কাটান। ইতোমধ্যে ঈসা খানের মিত্র খাজা সুলায়মান খান নুহানী এবং কেদার রায় মুগলদের কাছ থেকে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখল করেন। মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন এবং প্রচন্ড লড়াইয়ের পর ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন তিনি দুর্গটি পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের বর্ষাকালে মানসিংহ ঘোড়াঘাটে তাঁর শিবির স্থাপন করেন। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঈসা খান ও তাঁর মিত্রদের বিরুদ্ধে হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে একটি ছোট সৈন্যদল পাঠান। হিম্মত সিংহ নিকটবর্তী হলে ঈসা খান এগারসিন্ধুর এর দিকে পশ্চাদপসরণ করেন।
১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে মানসিংহ স্থল ও জলপথে ঈসা খানের বিরুদ্ধে দুটি বিরাট বাহিনী পাঠান। দুর্জন সিংহের অধিনায়কত্বে মুগল সেনাবাহিনী প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য লাভ করে, এমনকি তারা ঈসা খানের রাজধানী কাত্রাবোও আক্রমণ করে। কিন্তু শেষে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর থেকে ২০ কি.মি. দূরে এক নৌ-যুদ্ধে দুর্জন সিংহ নিহত হন এবং মুগল বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। এভাবে ঈসা খানের বিরুদ্ধে মানসিংহের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং হতোদ্যম সুবাহদার ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন।
১৬০১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে মানসিংহ দ্বিতীয়বার সুবাহদার হিসেবে বাংলায় আসেন এবং ১২ ফেব্রুয়ারি শেরপুর আতাই-এর যুদ্ধে আফগান বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন। পরের বছর তিনি ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায়কে মুগলদের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। উত্তরবঙ্গের মালদহ পর্যন্ত এলাকায় হামলাকারী জালাল খান ও কাজী মুমিনের মতো আফগান দলপতিদের বিরুদ্ধে মানসিংহ ঘোড়াঘাট থেকে তাঁর পৌত্র মহাসিংহের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। মহাসিংহ সে অঞ্চল থেকে আফগান দলপতিদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে বোকাইনগরের খাজা উসমান খান নুহানী ময়মনসিংহের মুগল থানাদার বজ বাহাদুর কলমাককে ভাওয়ালে বিতাড়িত করেন। ঘটনার এ গতি পরিবর্তনে মানসিংহ দ্রুত ঢাকা থেকে ভাওয়াল অভিমুখে অগ্রসর হয়ে উসমান খানকে পরাজিত করেন। এর অল্পকাল পরেই ইছামতি নদীর তীরে মানসিংহের সঙ্গে মুসা খান ও তাঁর ভাই দাউদ খান, উসমান খান ও কেদার রায়ের সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি যুদ্ধ হয়। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ বহু কষ্টে ত্রিমোহিনীর মুগল দুর্গে মগ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। মগদের সহায়তায় কেদার রায় শ্রীনগরে মুগল ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মানসিংহ উসমান খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভাওয়ালে ফিরে এলে উসমান খান পালিয়ে যান। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মানসিংহ আগ্রার উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন।
আকবরের শেষ দিনগুলিতে মানসিংহ আগ্রায় অবস্থান করেন এবং তাঁর ভাগ্নে খসরুকে সিংহাসনে বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর জাহাঙ্গীর মানসিংহকে তৃতীয় বারের মতো সুবাহদাররূপে বাংলায় পাঠান। তবে তৃতীয়বারে তাঁর সুবাহদারি ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং এসময় কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে বাংলা থেকে প্রত্যাহার করে বিহারে বদলি করা হয়। দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহের মৃত্যু হয়। [এ.এ শেখ মোঃ আসরারুল হক চিশতি]