বীরস্তম্ভ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বীরস্তম্ভ  মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাবশত নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের বিভিন্ন রকম ফর্ম বা অবকাঠামোর মধ্যে একটি। বীরস্তম্ভের শাব্দিক অর্থ ‘হিরো-স্টোন’, যা তামিল/কানারী ভাষার ‘বীরকল’ বা ‘বীরকুল্লু’-এর প্রতিশব্দ। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্প-ইতিহাস লেখায় এটি একটি হেয়ালিপূর্ণ বিষয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০ অব্দ (আরও পরবর্তী সময়কে সম্ভবত জোর করেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লিখিত তামিল সঙ্গম সাহিত্যে বীরস্তম্ভের সর্ব প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতের উপদ্বীপ অঞ্চলেই সম্ভবত বীরস্তম্ভের সবচেয়ে বেশি আধিক্য ছিল। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বীরস্তম্ভ বা এ জাতীয় স্থাপনার মোটামুটি বেশ কিছু উপস্থিতি পশ্চিম বাংলায় লক্ষ্য করা যায়।

উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের মতো আধুনিক-পূর্ব বাংলার সমাজে মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থাপত্যিক কাঠামো নির্মাণের প্রথা চালু ছিল। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলায় (আসানসোল সাব-ডিভিশন) বীরস্তম্ভগুলি পাওয়া গেছে। মেদিনীপুর জেলায় এগুলি পাওয়া গেছে উঁচু ভূমি এলাকায়, উপকূল বা সমতল পলল ভূমিতে নয়।

ভারতের উপদ্বীপীয় এলাকার মতো বাংলার বীরস্তম্ভগুলি কম্পোজিশনের দিক থেকে ততটা বিস্তারিত নয়। বীরের শৌর্য ও মৃত্যুর পর অন্তিম গন্তব্যের বিশদ বিবরণের পরিবর্তে বাংলার শিল্পিরা সাধারণ ও সারমর্ম ভিত্তিক বিবরণের দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সেই সাথে প্রাধান্য পেয়েছে বীর বা সতীর (নারী অর্থে) একক অবয়ব। তারা সাধারণ চক্ষুগ্রাহ্য বস্ত্তকেই প্রধান্য দিয়েছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বিষয়বস্ত্ত ছিল, হাতে একটি তরবারি ও ঢাল বা তীর ও ধনুক নিয়ে বীর একাকী দাঁড়িয়ে। বীরকে অনেক সময় ঘোড়ার পিঠে আসীন দেখা যায়। অল্প কয়েকটিতে হাতির পিঠে আসীন অবস্থাতেও দেখা যায়। একটু বিশদ বিষয়গুলিতে বীরের সাথে মাথার উপর ছাতার মতো আচ্ছাদন বহনকারী হিসেবে একজন সহকারীকেও দেখা যায়। আরও বিশদগুলিতে একদল খর্বকায় সহকারী দেখা যায়। সতী স্তম্ভগুলিও অত্যন্ত স্বল্প বিবরণে উপস্থাপিত। সতী হয় একাকী বসে বা দাঁড়িয়ে অথবা ছাতাধারী সহযোগী সহকারে আসীন। পরবর্তীযুগের কিছু নমুনায় সূর্য ও চাঁদের সাথে সতীর কঠোর হস্তের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রায় সবটাতেই বীর বা সতীকে বসে থাকা সিংহের পিঠে আসীন অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়, যা অনেকটা ঊড়িষ্যায় প্রচলিত বীরস্তম্ভের সাদৃশ্যে নির্মিত। বাংলার সাধারণ বীরস্তম্ভগুলিতে লেখার অংশটি একটি মাত্র প্যানেলের মাঝে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বুধপুর থেকে প্রাপ্ত একটি মাত্র নমুনায় নিচের প্যানেলে তরবারি ও ঢালসহ দন্ডায়মান হিরো এবং উপরের প্যানেলে পেছনে ছত্রধারী একজনসহ অশ্বারোহী হিরো দেখতে পাওয়া যায়। গতানুগতিক বীরস্তম্ভগুলি ছয় থেকে নয় ফুট উচ্চতার এবং এদের ভিত্তিগুলি অলঙ্কারবিহীন। উপরের অংশে বীর ও মুকুট পরিহিত সিংহ দৃশ্যমান। একটি মাত্র নমুনা পাওয়া গেছে মাত্র ছয় ইঞ্চির, যাতে তরবারি ও ঢালসহ বীর উৎকীর্ণ রয়েছে। সম্ভবত মন্দিরে দান হিসেবে এটি গড়া হয়েছিল।

বীরস্তম্ভগুলি স্থানীয় পাথরের উপরই উৎকীর্ণ হতো। অন্যদিকে পুরুলিয়ার শিল্পীরা বেলেপাথর ও ক্লোরাইট স্ফটিক ব্যবহার করেছেন। বর্ধমানে ব্যবহার করা হয়েছে বেলেপাথর, আর মেদিনীপুরে লাল মাটির ব্লক। তাই স্বাভাবিকভাবেই এক স্থানের বীরস্তম্ভ অন্য স্থান থেকে হয়েছে ভিন্ন। লাল মাটির ব্লকে নির্মিত মেদিনীপুরের বীরস্তম্ভগুলি পাথরের অসম পৃষ্ঠের ঘর্ষণে বেশিরভাগ সূক্ষ্মতাই হারিয়েছে। অবশ্য এই নমুনাগুলিতে এধরনের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য যে এক ধরনের রঙের আস্তর দেওয়া হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে।

সাধারণত বাংলার বেশিরভাগ বীরস্তম্ভ পাল-সেন যুগের দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রায় কাছাকাছি। এটি আরও পরিষ্কার হয় যখন বুধপুরের বড় বড় স্তম্ভগুলির সাথে ঐ একই স্থানের সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য ভাস্কর্যগুলির তুলনা করা হয়। বুধপুর, ছররা, গৌরী, বনপটুয়া, বড়ুয়া বা হরিষপুরের বীরস্তম্ভগুলিতে পেশীবহুল দেহকাঠামোর দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয় সাধন হওয়ার পরও এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করা যায়।

তবে একই সাথে সমতল ও দ্বিমাত্রিক ফর্মের কাজও চোখে পড়ে। পাথরের উপর খোদাই করে দেহ-কাঠামো ফুটিয়ে তোলা হয়। এধরনের কাজকে তুলনা করা যায় কাঠের উপর খোদাই কাজের সাথে।

যেহেতু একই স্থান থেকে ভারী দেহকাঠামো ও সমতল উভয় ফর্মের বীরস্তম্ভ পাওয়া যাচ্ছে, তাই দুই ধরনের ফর্মের কোন নির্দিষ্ট কাল সীমা থাকাটা অসম্ভব। সম্ভবত বোরাম বা বুধপুরের মতো প্রত্নস্থলগুলি দুই শতকেরও অধিককাল ব্যাপী কর্মব্যস্ত থাকায় একই সাথে দুটি স্থানের শিল্পি সমান্তরালে দুটি ভিন্ন রীতি চালু রাখতে পেরেছিল।

তেরো ও চৌদ্দ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় বীরস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। গরুই-এর অপাঠযোগ্য সতী প্রস্তরলিপি তেরো ও চৌদ্দ শতকের বলেই প্রতীয়মান হয়। পুরুলিয়া জেলাতে একই সময়ের বেশ কিছু বীরস্তম্ভ পাওয়া যায়। এটি ইঙ্গিত বহন করে যে, বীরস্তম্ভগুলি এগারো থেকে চৌদ্দ শতকে নির্মিত হয়েছিল। রীতিগত সময়কাল নির্ধারণে অনিশ্চয়তা এবং লিপিগত প্রমাণের চরম অভাব সত্ত্বেও এটি গ্রহণ করা খুব অযৌক্তিক হবে না যে, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় নির্মিত বীরস্তম্ভগুলির বেশিরভাগই এ সময়ে নির্মিত হয়েছিল।

দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বীরস্তম্ভ ও সতী প্রস্তরগুলি এ অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক এলিটশ্রেণী ও স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যেকার সংঘাতের স্মৃতি বহন করে। যদিও লিপিতথ্যে বা অন্য কোন লিখিত উৎসে এর উল্লেখ নেই তথাপি বলা যায় যে, এ সংঘাত ছিল এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কেন না মধ্যযুগ আসার আগেই সদ্য-হিন্দু ধর্মাবলম্বী উপজাতীয় প্রধানদের প্রভাবে ‘ভূম’ নামক ভূ-রাজনৈতিক একাত্মতার অস্তিত্ব প্রকাশ শুরু করেছিল। তাৎপর্যগতভাবে এই এলাকাটি প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাসে ছিল সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। উদাহরণস্বরূপ, তেলকুপি অঞ্চলটির শাসনকর্তা ছিলেন পাল সামন্ত শাসক রুদ্র শিখর, আর এলাকাটি ‘শিখরভূম’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। এটি আদিবাসী অধ্যুষিত সমাজে বর্ণহিন্দুর দৃষ্টিভঙ্গির অনুপ্রবেশের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।  [গৌতম সেনগুপ্ত]

গ্রন্থপঞ্জি  S Settar & GD Sontheimer (ed), Memorial Stones: A Study of the Origin, Significance and Variety, Dharwad, 1982; Gautam Sengupta, ‘Hero Stone of West Bengal: A Preliminary Report’, Journal of Bengal Art, 4, Dhaka , 1999.