মিটফোর্ড, রবার্ট
মিটফোর্ড, রবার্ট (১৭৮২-১৮৩৬) ঢাকা জেলার কালেক্টর, ঢাকা প্রাদেশিক আপিল ও সার্কিট আদালতের (Provincial Court of Appeal and Circuit Dhaka) দ্বিতীয় জজ বা বিচারক, বাংলাদেশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এর দাতা। রবার্ট মিটফোর্ড ১৭৮২ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ইংল্যান্ডের সর্ব-উত্তরের কাউন্টি (প্রদেশ) নর্দাম্বারল্যান্ড-এ অবস্থিত মিটফোর্ড ক্যাসল বা মিটফোর্ড দুর্গ প্রাসাদের (Mitford Castle) অভিজাত মিটফোর্ড পরিবার। তাঁর পিতা জন মিটফোর্ড ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর সময় থেকেই মিটফোর্ড পরিবারের প্রাচ্য দেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রবার্ট মিটফোর্ড লন্ডনে লেখাপড়া করেন। তিনি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ১৬ বছর বয়সে কোম্পানির রাইটার (Writer) পদে চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে পাড়ি জমান। তাঁকে কোম্পানির বেঙ্গল ইস্টাব্লিশমেন্ট বা বাংলার বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। রাইটার পদের চাকুরেরা তখনকার দিনে স্বীয় মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। রবার্ট মিটফোর্ড কলকাতা, মুর্শিদাবাদ এবং বিহারে চাকরি করার পর ঢাকা জেলার কালেক্টর হিসেবে ১৮১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নগর ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। মিটফোর্ড ঢাকায় আসার স্বল্প সময়ের মধ্যেই একজন দক্ষ কালেক্টর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চার বছর সফলতার সঙ্গে জেলা কালেক্টরের দায়িত্ব পালনের পর রবার্ট মিটফোর্ড কোম্পানির অধীনে বিচার বিভাগীয় পদে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন। তাঁর আবেদন গৃহীত হয় এবং তিনি ১৮২২ সালে ঢাকা প্রভিন্সিয়াল কোর্ট অব আপিল অ্যান্ড সার্কিট এর দ্বিতীয় বিচারক নিযুক্ত হন। এ পদে তিনি ১৮২৮ সালের ২০ মে পর্যন্ত বহাল ছিলেন এবং এই তারিখ থেকেই অবসরে যান। বিচারক হিসেবেও মিটফোর্ড ঢাকায় সুনাম অর্জন করেন।
তিরিশ বছর ভারতবর্ষে অবস্থান করার পর ১৮২৮ সালে মিটফোর্ড দেশে ফিরে যান। ১৮৩৬ সালে তিনি প্যারিস ভ্রমণে যান এবং সেখানে ২১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
রবার্ট মিটফোর্ড মৃত্যুর আগে তাঁর বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে একটি উইল করে যান। এ উইলের নবম ধারায় বলা হয় যে তাঁর উইলের অন্যান্য ধারায় বর্ণিত নির্দেশ পূরণ করার পর যে অবশিষ্ট সম্পত্তি ও অর্থ থাকবে তা থেকে তার ঘোড়াগুলির পেনশনভোগী হিসেবে পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংরক্ষিত রেখে বাকি টাকা ঢাকা শহরে দাতব্য, উপকারী এবং জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যয় করার জন্য প্রেরণ করতে হবে।
রবার্ট মিটফোর্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ এবং তাঁর ‘বান্ধবী’ ম্যারি আপোলিন এই উইলের বিরোধিতা করে মামলা করেন। বিভিন্ন আদালতে এবং দীর্ঘ সময় ধরে এই মামলা চলতে থাকে এবং এতে বহু আত্মীয়স্বজন, ব্রিটিশ সরকার এবং ভারত সরকার জড়িয়ে পড়ে। মিটফোর্ডের উইল সংক্রান্ত মামলা ১৮৫০ সাল পর্যন্ত চলে। পরে লন্ডনের হাইকোর্টের চান্সারি বিভাগ উইলের বৈধতার স্বীকৃতি দিয়ে রায় দেয় এবং মিটফোর্ডের উইল অনুযায়ী তার সম্পদ ও অর্থের অবশিষ্টাংশ ঢাকায় প্রেরণ করতে নির্দেশ দেয়।
মিটফোর্ডের দেয়া সম্পত্তি ও অর্থ দিয়ে মিটফোর্ড বিকোয়েস্ট ফান্ড (Mitford Bequest Fund) গঠন করা হয়। এ ফান্ডে ১৮৬০ সালের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ টাকা জমা পড়ে। এ টাকা দিয়ে কি করা হবে সে সম্পর্কেও মিটফোর্ডের কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশ ছিল না। তাই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি মতামত দেন যে দাতা মিটফোর্ডের সদিচ্ছা ফলপ্রসূ ও যথাযথ হবে যদি তাঁর দেয়া অর্থ দিয়ে ঢাকায় তথা পূর্ববাংলার জনগণের জন্য ঢাকায় একটি পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে পরিচালিত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি সেভাবে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এটিও চূড়ান্ত করা হয় যে হাসপাতালটির নাম দাতা মিটফোর্ডের নামানুসারে মিটফোর্ড হাসপাতাল রাখা হবে। এভাবে ১৮৫৮ সালের ১ মে মিটফোর্ড হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয়। উল্লেখ্য যে ঢাকার জন্য মিটফোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক দানের চূড়ান্ত পরিমাণ ছিল ১৭,৭৪৮ পাউন্ড ১২ শিলিং এবং ৩ পেন্স বা ১,৭৭,৪৮৬ টাকা ২ আনা। [শরীফউদ্দিন আহমেদ]
গ্রন্থপঞ্জি শরীফউদ্দিন আহমেদ, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল স্কুল: ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৫৮-১৯৪৭, ঢাকা, ২০০৭; Papers Relating to the case Between Mrs Anne Mitfore Vs Henry Revell Reynolds, The East India Company & Others, T.S.11/154/409, Paper VII, Public Records Office, London (Now National Archives of UK.).