ভূমি অধিগ্রহণ
ভূমি অধিগ্রহণ দেশের আইনের বিধান অনুযায়ী জনসাধারণের কল্যাণের লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বেসরকারি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। বর্তমান বাংলাদেশের ভূখন্ডে এ ধরনের আদিতম বিধিবদ্ধ আইন হলো ১৮২৪ সালের ১ নং বঙ্গীয় প্রবিধান। লবণ উৎপাদন শিল্পে ব্রিটিশ বাণিজ্যস্বার্থ রক্ষায় এই আইন প্রণীত হয়। ১৮৫০ সালের ১নং আইন এই আইনের স্থলবর্তী হয় এবং জনপূর্ত কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের বিধান করা হয়। ১৮৫০ সালের ৪২নং আইনবলে রেলপথ নির্মাণকে জনকল্যাণমুখী বলে ঘোষণা করা হয়। সরকার জমির হুকুমদখল এবং সড়ক, খাল ও রেলপথ নির্মাণে প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহের জন্য জমির সাময়িক দখল গ্রহণের লক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত ক্ষমতা গ্রহণ করে।
পরে জমি হুকুমদখল সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন একত্রিত ও সংহত করে ১৮৫৭ সালের ৬নং আইন পাশ করা হয়। এই আইন গোটা ব্রিটিশ ভারতে প্রয়োগযোগ্য করা হয়। সেচ, নৌপরিবহণ, ডক ও পোতাশ্রয় উন্নয়নের উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে কর্তৃত্ব প্রদানের জন্য ১৮৬৩ সালের ২২নং আইন শিরোনামে এক নতুন আইন পাশ হয়। এই আইনের আওতায় গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিল এ ধরনের কাজগুলিকে জন উপযোগমূলক কাজ (public utility) হিসেবে ঘোষণার ক্ষমতা লাভ করেন। সম্পর্কিত আইনগুলির সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংহতকরণ প্রক্রিয়া ১৮৭০ সাল অবধি অব্যাহত থাকে। ১৮৭০ সালে ১০নং আইন পাশ হয়।
১৮৭০ সালের আগে ভূমি অধিগ্রহণ আইনের সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, কালেক্টর ও জমির মালিকের মধ্যে যে জমি হুকুমদখলের প্রস্তাব করা হয়েছে সে জমির মূল্য সম্পর্কে ঐকমত্য না হলে বিষয়টি পুরোপুরি সালিশদারদের এখতিয়ারাধীনে চলে যাবে। তারা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তার বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাবে না। এ ব্যবস্থায় সরকারি অর্থের পরিতাপজনক অপচয় ঘটে। কেননা, প্রায়ই দেখা যায়, সালিশদারগণ তাদের কাজে যোগ্য নন। তারা দুর্নীতিগ্রস্তও বটে। আইনের এই গলদ ১৮৭০ সালের ১০ নং আইনে দূরীভূত হয়। এ আইনে সালিশির ব্যবস্থাও তুলে দেওয়া হয়। স্থির হয়, কালেক্টর ও জমির মালিকের মধ্যে জমির মূল্যের বিষয়ে মতপার্থক্য হলে বিষয়টি সিদ্ধান্তের জন্য দেওয়ানি আদালতে পাঠানো হবে। দেওয়ানি আদালতের বিচারক দুই সালিশদারের মধ্যে অন্তত একজনের সঙ্গে একমত হতে পারলে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। আবার দুই সালিশদারের সাথেই বিচারক দ্বিমত পোষণ করলে সেক্ষেত্রে সাধারণত হাইকোর্টে আপিলের অনুমতি দেওয়া হতো। এ কারণে একাধিক মামলা হতো, নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ও ব্যয়বাহুল্য ঘটত। আইনটি এ কারণে পুরোপুরি ফলদায়ক না হওয়ায় ১৮৯৪-এর আইনে বাতিল হয়ে যায়।
নিয়মিত কোন মামলায় দেওয়ানি আদালতের ডিক্রিতে পরিবর্তন না হলে, ১৮৯৪ সালের আইন কালেক্টরের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে স্থির করে দেয়। এই আইনের উদ্দেশ্য, জমির হুকুমদখলের ক্ষেত্রে দ্রুততর ক্ষতিপূরণ নিরূপণের একটি পদ্ধতির ব্যবস্থা করা। এই সর্বাঙ্গীণ প্রকৃতির আইনের আওতায় জরুরি পরিস্থিতির জন্য ব্যবস্থা ছিল। ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কালেক্টরকে কোন জমির দখল নেওয়ার কৃতিত্বাধিকার দেওয়া হয় নি। তবে আইনের ১৭ ধারার আওতায় ১৫ দিনের নোটিশের মেয়াদশেষে, এমনকি, জমির ক্ষতিপূরণ স্থির করার আগেও জমির দখল গ্রহণের ক্ষমতা কালেক্টরকে দেওয়া হয়েছে। তবে অসুবিধা কমানোর জন্য সাময়িক প্রাক্কলনের (estimate) ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ পরিশোধের বিষয়টিকে কালেক্টরের জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। এই সাময়িক প্রাক্কলন হবে যথাক্রমে, ক. নির্মিত কাঠামো ও ভবনের ১০%; খ. বাড়ি, চালাঘর/ছাউনি ও ফলের বাগানের ৭৫%; গ. খালি নাল জমির ৫০%। এই আইনে রাস্তাঘাট ও বাঁধ মেরামতে মাটি সরানোর/স্থানান্তর করার জন্য জমির সাময়িক দখল গ্রহণের বিধান রাখা হলেও বাড়িঘর ও ভবনের অধিযাচিত দখল গ্রহণের কোন বিধান নেই।
১৮৯৪ সালের ১ নং আইনের আওতায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের বেলায় কালেক্টরের কাজ হলো তার মতে জমির মূল্য কত হতে পারে সেই অঙ্ক নির্ধারণ করা। এই ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের কার্যপ্রক্রিয়াগুলি বিচার বিভাগীয় কিছু নয় বরং তা প্রশাসনিক। আর এক্ষেত্রে কালেক্টরের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত আদালত কর্তৃক পুনর্বিবেচনাযোগ্য। এ সম্পর্কিত বিরোধে সিদ্ধান্তের জন্য জমির মালিকের বিষয়টি আদালতে উত্থাপনের অধিকার ছিল। এটি অবশ্য বুঝে নিতে হবে, জমির সঠিক মূল্যায়ন নির্ধারণ করা এক অসম্ভব কাজ, বড়জোর এর একটা কাছাকাছি বাজারমূল্যে উপনীত হওয়া যায়। এজন্য গাণিতিক নির্ভুলতায় জমির ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ সম্ভব নয়। জমির ক্ষতিপূরণ নিরূপণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় যেসব বিষয় অবশ্য বিবেচ্য এই আইনে কেবল সেগুলিরই বিধান রয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর গোটা পূর্ববাংলা প্রদেশব্যাপী বহুসংখ্যক সরকারি দপ্তরের স্থান সঙ্কুলান ও সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য ১৪ জুলাই, ১৯৪৭-এ পূর্ববঙ্গীয় জরুরি সম্পত্তি অধিযাচিত দখল অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তারপরও তীব্র আবাসিক সংকট অব্যাহত থাকে। নতুন এই প্রদেশটির জন্য নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প সরবরাহ ও নানা ধরনের সেবার জন্য দ্রুত ও জোরদার উন্নয়ন প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য ‘(জরুরি) সম্পত্তি অধিযাচিত দখল আইন, ১৯৪৮’ শিরোনামে এই আইন পাস করা হয়। এই আইনে স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তির আশু অধিযাচিত দখল গ্রহণের জন্য এক সংক্ষিপ্ত কর্মপদ্ধতির বিধান রাখা হয়। এই কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মালিকানা কিংবা ঐ সম্পত্তির দখলদার পক্ষের ওপর ডেপুটি কমিশনার কেবল বিজ্ঞপ্তি জারি করে কাজটি করতে পারতেন। এ আইনে সম্পত্তির দখল গ্রহণের জন্য দুই স্তরের ব্যবস্থা ছিল। এই দ্বি-স্তর ব্যবস্থায় প্রথমে অনতিবিলম্বে জমির দখল গ্রহণের জন্য অধিযাচন করা হতো ও তারপর স্থায়ী দখলের জন্য কার্যব্যবস্থা অনুসৃত হতো। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-এর অধ্যাদেশের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি রেখে দিয়ে এই নতুন আইনে সেগুলির আরও উন্নতি সাধন করা হয়। সম্পত্তি/ভূমির স্থায়ী দখল গ্রহণের বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার হলেও ডেপুটি কমিশনার সরকারের পরবর্তী অনুমোদন সাপেক্ষে যে কোন সম্পত্তি অধিযাচন করার পর তা দখলে নিতে ও স্থায়ী অধিগ্রহণ করতে পারতেন।
এই আইনের আওতায় প্রদত্ত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা আবেদন গ্রহণ করার ব্যাপারে আদালতের এখতিয়ার রহিত করা হয়। এই আইনে বিচার এখতিয়ারের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা অবশ্য প্রকৃত অর্থেই আদালতের এখতিয়ারের পরিপূর্ণ উৎখাত বোঝায় নি। বরং আদালত নিজে সত্যিকার অর্থেই তার এখতিয়ার থেকে উৎখাত হয়েছে কিনা আদালত নিজেই সে বিচার করার অধিকারী হয়েছে। কাজেই উল্লিখিত বাধা সত্ত্বেও এই আইনের আওতায় প্রদত্ত কোন আদেশ আইনে প্রদত্ত অধিকারের মধ্যে থেকে বা কোরাম নন জুডিস (coram non judice) কিংবা অসদুদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়টি স্থির করার এখতিয়ার আদালতের বজায় রয়েছে। আর তাই আদালত তেমন ক্ষেত্রে উল্লিখিত কারণগুলির ভিত্তিতে যে কোন বিশেষ আদেশ বাতিল করে দিতে পারে।
১৮৯৪ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইনটি অবশ্য ১৯৪৮ সালের ১৩ নং আইন পাশ হওয়ার পরেও বজায় রাখা হয়। তবে ক্বচিৎ এ আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ, দেখা যায়, ১৮৯৪ সালের আইনের আওতায় যে কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় তা অধিযাচনাধীন সম্পত্তির জন্য মন্থর ও দীর্ঘসূত্রী এবং অধিযাচনাধীন সম্পত্তির আগে দখল গ্রহণ করে পরে তার স্থায়ী দখল গ্রহণের কার্যপদ্ধতির সূচনা করা ছিল সবসময়েই সুবিধাজনক।
ভূমি অধিগ্রহণের আইনটির আবার পুনর্বিবেচনা করার পর ১৯৮২ সালে তা সুসংহত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, ১৯৪৮ সালের সম্পর্কিত আইনে যে কঠোর কার্যপদ্ধতির ব্যবস্থাপত্র ছিল তার বিরুদ্ধে স্থাবর সম্পত্তির মালিককে যুক্তিসঙ্গত রক্ষাব্যবস্থা প্রদান করা। সেভাবেই ১৯৮২ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও অধিযাচিত দখল অধ্যাদেশ (১৯৮২ সালের ১১ নং অধ্যাদেশ) জারি করা হয়। ১৮৯৪ সালের আইনটি বাতিল করা হয় ও বৈধতার নির্ধারিত মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ায় ১৯৪৮ সালের আইনটির স্বাভাবিক অবসান ঘটে।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ এবং নদীভাঙন নিবারণের স্থায়ী ব্যবস্থাদির জন্য স্থাবর সম্পত্তির দ্রুত দখল গ্রহণের প্রয়োজনে পাঁচ বছরের সাময়িক মেয়াদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন, ১৯৮৯ (১৯৮৯ সালের ৯ নং আইন) নামে এক নতুন আইন পাশ করা হয়। এই সাময়িক আইনকে অন্যান্য সকল আইনের ওপর নিরঙ্কুশ ধরনের আধিপত্য প্রদান করা হয়, যার অর্থ এই আইনের বিধানগুলি বলবৎ অন্য যে কোন আইনের পরিবর্তে বহাল হবে। এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ডেপুটি কমিশনার মালিকের ওপর নোটিশ জারি করে স্থাবর/অস্থাবর যে কোন সম্পত্তি অধিগ্রহণের আদেশ দিতে পারেন। এই অধিগ্রহণ আদেশ চ্যালেঞ্জ করার অধিকার মালিককে দেওয়া হয় নি, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ডেপুটি কমিশনারের কাছে ঐ সম্পত্তিতে তার স্বার্থের দাবি পেশ করতে পারেন। এই আইনের মেয়াদ ছিল ১৯৯৪ সাল অবধি। উক্ত মেয়াদান্তে আইনটির স্বাভাবিক অবসান ঘটেছে।
১৯৮২ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও অধিযাচিত দখল অধ্যাদেশ (১৯৮২ সালের ১১ নং অধ্যাদেশ) বর্তমানে বাংলাদেশে (তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া) জমির হুকুমদখলের ক্ষেত্রে একমাত্র আইনগত দলিল। এই আইনে সরকারি উদ্দেশ্যে ও জনস্বার্থে উপাসনাস্থল, গোরস্থান বা শ্মশানঘাট ছাড়া স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও অধিযাচন ভিত্তিতে দখল গ্রহণের বিধান রয়েছে। এতে বিস্তারিত কার্যপদ্ধতিরও বিবরণ রয়েছে যাতে ডেপুটি কমিশনার পদ্ধতিসম্মতভাবে ও সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে জমি দখলের কাজে অগ্রসর হতে পারেন আর জমি মালিকের জন্যও আপত্তি তোলার সুযোগ থাকে। যথাশুনানি গ্রহণ করে এসব আপত্তিরও অবশ্যই নিষ্পত্তি করতে হবে।
১৯৪৮ সালের আইনের আওতায় ভূমি হুকুমদখলের প্রতি ক্ষেত্রেই সরকারের অনুমোদন আবশ্যক, যদিও ডেপুটি কমিশনার তার অধিযাচন ক্ষমতার আওতায় সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দখল গ্রহণ করতে পারেন ও এভাবে নিষ্পন্ন কার্য (fait accompli) হিসেবে আইনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই ঐ সম্পত্তি আলাদা করে নিতে (alienation) পারেন। এই নতুন আইনে হুকুমদখল গ্রহণাধীন জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার (৬.৬৮৯ হেক্টর) অধিক না হলে ও জমির মালিকের তরফ থেকে আপত্তি না থাকলে হুকুমদখলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ডেপুটি কমিশনারের রয়েছে। আর যদি জমির মালিকের আপত্তি থাকে তাহলে এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের অনুমোদন আবশ্যক হবে।
আগের আইনে জমি হুকুমদখল প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের বেলায় এই নতুন ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণে বিলম্বের ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতো এবং দ্রুততর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টির ওপর বিদেশি অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি চাপ সৃষ্টি করত। তাই জমি অধিগ্রহণের বেলায় যেভাবে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় তা হলে, জমি হুকুমদখলের প্রস্তাবিত পরিমাণ ৫০ বিঘা (৬.৭ হে.) পর্যন্ত হলেও হুকুমদখলে আপত্তি না উঠলে ৪৫ দিন এবং আপত্তি উঠলে ৭৫ দিন, জমি হুকুমদখলের প্রস্তাবিত পরিমাণ ৫০ বিঘার বেশি হলো ও হুকুম দখলে আপত্তি না উঠলে ১০৫ দিন এবং আপত্তি উঠলে ১৩৫ দিন।
সিদ্ধান্ত বা রায় চূড়ান্তকরণের জন্য অতিরিক্ত সর্বাধিক অনুমোদিত সময়সীমা ১১২ দিন। এভাবে, কোন হুকুমদখল মামলায় জমির পরিমাণ ৫০ বিঘা পর্যন্ত হলে এখন তা চূড়ান্ত করার সর্বাধিক সময়সীমা দাঁড়ায় ১৮৭ দিন আর জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার বেশি হলে ২৭৪ দিন।
ডেপুটি কমিশনার এই অধ্যাদেশের ৮ ও ৯ ধারা অনুসারে জমির ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে বাধ্য। এরপর তাকে জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব পেশ ও জমির দখল গ্রহণের আগে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। যদি ঐ জমির মালিক ক্ষতিপূরণের অর্থ গ্রহণ না করেন কিংবা আপত্তি তোলেন সেক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনার ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারি ট্রেজারিতে রাজস্ব জমা হিসেবে গচ্ছিত রাখবেন। এভাবে ঐ অর্থ জমা হয়ে যাবার পর আইনের দৃষ্টিতে ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে গৃহীত হবে ও ডেপুটি কমিশনার সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দখল গ্রহণের যোগ্য হবেন। কোন জমির মালিক জমির ক্ষতিপূরণে তার অংশ বা ক্ষতিপূরণ সিদ্ধান্ত অপর্যাপ্ত মনে করলে তেমন ক্ষেত্রে আইনের বিধান অনুযায়ী তিনি বিষয়টি সালিশদারের সমীপে কিংবা সালিশ আপিল ট্রাইবুন্যালে উত্থাপন করতে পারবেন। এই দুই সালিশ কর্তৃপক্ষ হবেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও তারা হবেন যথাক্রমে সাব জজ ও জেলা জজ পদমর্যাদার অধিকারী।
বর্তমান আইনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, যে উদ্দেশ্যে জমি হুকুম দখল করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যে ঐ জমির ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান। যে উদ্দেশ্যে কোন জমি হকুমদখল করা হয় তা অন্য উদ্দেশ্যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সরকারি পূর্বানুমতি ছাড়া, ব্যবহার নিষিদ্ধ। ব্যবস্থাটি গ্রহণের প্রয়োজন হয়েছে এ কারণে যে, যেসব কর্তৃপক্ষ জমি দখলের প্রয়োজনের কথা জানান তারা সাধারণত যতটুকু জমি তাদের সত্যিকার অর্থেই দরকার তারও চেয়ে বেশি জমি হুকুমদখল করান, আর এরকম জমি যে উদ্দেশ্যে হুকুমদখল করানো হয়, হয় তারা সে উদ্দেশ্যে জমি ব্যবহার করেন না বা জমি দীর্ঘকাল অব্যবহূত অবস্থায় ফেলে রাখেন। এতে ভূমির মতো বিরল সম্পদের ওপর চাপ পড়ে। তাই আইনে এখন ব্যবস্থা হয়েছে, যে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যে যদি ঐ জমি ব্যবহার করা না হয় কিংবা তা অব্যবহূত অবস্থায় ফেলে রাখা হয় তাহলে ঐ জমি ডেপুটি কমিশনারের কাছে সমর্পণ করতে হবে।
ভূমি অধিগ্রহণের আইন স্বত্ববঞ্চিতকারক (Exproprietory) সংবিধি আইন বিধায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গ ও পরিবারসমূহকে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের জমি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এ আইনে হুকুমদখলের বাধ্যতামূলক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় জমির জন্য প্রকৃত ক্ষতিপূরণের একটা নির্ধারিত শতকরা হারে (বর্তমানে পঞ্চাশ শতাংশ) অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সরকারি উদ্দেশ্যে কিংবা জনস্বার্থে কেবল সরকারের পূর্ব অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পত্তির সাময়িক অধিযাচিত হুকুমদখলেরও বিধান রয়েছে। অবশ্য এই পূর্বানুমতি গ্রহণের শর্ত জরুরি ক্ষেত্রে আরোপ করা হয় না। বিধানটি হলো এই যে, একমাত্র জরুরি পরিস্থিতি ব্যতিরেকে, পরিবহণ বা যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে কোন সম্পত্তি যা তার মালিক সত্যিকার অর্থেই তার নিজ বা তার পরিবারের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করেন কিংবা যে জমি জনসাধারণ তাদের ধর্মীয় উপাসনাস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা বা হাসপাতাল, গণগ্রন্থাগার, গোরস্থান বা শ্মশান হিসেবে ব্যবহার করেন এমন সম্পত্তি অধিযাচিত অধিগ্রহণ করা যাবে না। এই বিধান নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার দূষণীয় (culpable) ব্যবহার থেকে নাগরিকদের জন্য মূল্যবান রক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে।
এই অধ্যাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ভূমির চলতি অধিযাচন প্রক্রিয়াকে পূর্ববর্তী আইনের বিধানগুলি থেকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। এই দুই বিধান হলো, ক. হুকুমদখলাধীন সম্পত্তিটির ব্যবহার ও দখলের উদ্দেশ্যে যদি সংশ্লিষ্ট মেয়াদের জন্য তা ইজারায় দেওয়া হতো ও তার জন্য যে ভাড়া প্রদেয় হতো তার সাথে সঙ্গতি রেখে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ, এবং খ. সম্পত্তিটি যদি দুই বছরেরও বেশিকাল অধিযাচিত হুকুমদখলে রাখা হয় তাহলে ক্ষতিপূরণ সংশোধন।
জমি অধিগ্রহণ আইন প্রশাসনের কাজ করে থাকে বিভাগীয় পর্যায়ে কমিশনার ও জেলা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনারের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়। ঢাকা ও আরও কয়েকটি বিভাগীয় সদর দপ্তরে ভূমি অধিগ্রহণ মামলাগুলির গুরুত্ব এবং সংখ্যাধিক্য বিবেচনায়, এই কাজে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তারা ছাড়াও জেলা কমিশনারকে একজন অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি অধিগ্রহণ) সহায়তা করে থাকেন। ভূমি ডেপুটি কমিশনারগণ যাতে তাদের এই কাজগুলি যথাযোগ্যভাবে এবং আইনের এখতিয়ারের মধ্যে থেকে আইনের মূল উদ্দেশ্যানুযায়ী সম্পাদন করেন সে বিষয় নিশ্চিত করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় মাঝে মাঝেই নির্বাহী আদেশ জারি করেন।
অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের গৃহীত প্রকল্পের জন্য প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ জমি প্রয়োজন তা নির্ধারণের জন্য কষ্ট স্বীকার করে না। তাদের বর্তমান চাহিদার পরিবর্তে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জমি চাওয়ার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনই সাধারণত একতরফাভাবে স্থির করে তাদের কতটুকু জমি প্রয়োজন। আর যে জমি বরাদ্দ কমিটি জেলা ও জাতীয় স্তরের জন্য এসব চাহিদার অনুমোদন দান করে সেসব কমিটির হাতে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলি খুঁটিয়ে যাচাই করার সময় খুব কমই থাকে। এ বিষয়ে তেমন ক্ষমতাও তাদের থাকে না। সাধারণত তাই তারা আনুষ্ঠানিকতার গতানুগতিক ধারায় জমি চাহিদার প্রস্তাবগুলির অনুমোদন দিয়ে থাকে।
জমি অধিগ্রহণের ফলে স্থানীয় লোকালয় বা জনসমষ্টির ওপর কী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পড়ে তা নির্ধারণ করা কার্যত অসম্ভব ও কঠিন ব্যাপার। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় ভূমিসম্পদ নিতান্তই অপ্রতুল। তাই এ দেশের পক্ষে উন্নয়নের নামে ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার সম্ভব নয়। প্রকল্পের স্থান বাছাইয়ের বেলাতেও উল্লিখিত ধরনের অসাবধানি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতি জেলাতেই ডেপুটি কমিশনারের সভাপতিত্বে একটি এরকম স্থান নির্বাচন কমিটি থাকলেও এই কমিটি ক্বচিৎ ঐসব প্রস্তাবিত প্রকল্পস্থল পরিদর্শনে যান। এর ফলে প্রকল্পের জন্য স্থানটির উপযুক্ততা যাচাইয়ের অভাবে মূল্যবান আবাদি জমি তো বটেই, শহরের উপকণ্ঠ এলাকার জমিগুলিও অতি সচরাচর অ-কৃষি জমিতে রূপান্তর ও সেভাবে ব্যবহার করা হয় এবং তাতে আবাদি জমির অভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জমি উপযুক্ত কিনা কিংবা জনসাধারণের এতে প্রতিক্রিয়া কী এসব নিরূপণের লক্ষ্যে ডেপুটি কমিশনার যাতে প্রকল্পস্থল পরিদর্শনে যান সেই নির্দেশ দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় সকল ডেপুটি কমিশনারকে একটি পরিপত্র পাঠিয়েছে। বিধি সংশোধন, নোটিশ ও সার্কুলার ইস্যু ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলিকে সর্বাধিক স্বস্তি দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় প্রশাসন যন্ত্রের কাজের ওপর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখছে।
তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে বর্তমানে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ আমল থেকেই বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় সকল পার্বত্য ভূমির মালিক সরকার। এসব ভূমি সংরক্ষিত বন বা অশ্রেণীকৃত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চল হিসেবে বিদ্যমান। এই পার্বত্য জেলাগুলি প্রশাসনের একমাত্র আইনানুগ হাতিয়ার হলো ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান (১৯০০ সালের ১ নং প্রবিধান)। এর আওতায় ডেপুটি কমিশনার আগে বসতি স্থাপিত হয়ে থাকলেও সেসব ভূমির দখল গ্রহণে ক্ষমতাবান। কিন্তু প্রবিধানের আওতায় প্রণীত বিধি অনুযায়ী, অনুরূপ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালের প্রবিধান অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারকে জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হলেও ১৯০০ সালের ১ নং প্রবিধান অনুযায়ী অধিগ্রহণ করা যায় না। [আমিনুল হক]