মাধবপাশা জমিদার পরিবার
মাধবপাশা জমিদার পরিবার বরিশাল জেলার একটি সুপ্রাচীন জমিদার পরিবার। চৌদ্দ শতকের শুরুতে সোনারগাঁওয়ের দনুজমর্দন দেব মুসলিম বিজয়ীদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার পর বর্তমান বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে একটি ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দনুজমর্দন দেব বা দনুজ রায় ছিলেন মাধবপাশা জমিদারদের পূর্বপুরুষ। চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের উন্মাদ রাজা শিবনারায়ণ কর্তৃক নথিপত্র পোড়ানোর পর ইদিলপুরের ঘটক সম্প্রদায়ের দলিল, নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত মাধবপাশা রাজপরিবারের বংশ তালিকায় দনুজমর্দনকে চন্দ্রদ্বীপ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দনুজমর্দনের উত্তরাধিকারীরা ছিলেন রমাবল্লভ, কৃষ্ণবল্লভ এবং হরিবল্লভ।
রমাবল্লভের পুত্র রাজা কৃষ্ণবল্লভ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হরিবল্লভের সময় (১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য স্বাধীন ছিল। এরপর চন্দ্রদ্বীপ মুসলিম সুলতান ও আফগান শাসকদের আশ্রিত বা করদ রাজ্য হিসেবে শেষ আফগান শাসক দাউদ খান কররানীর (১৫৭৩-১৫৭৬) মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। হরিবল্লভের পুত্র জয়দেবের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় কন্যা কমলাদেবী রাজ্য শাসন করেন। রাজকুমারী কমলাদেবীর বিয়ে হয় পন্ডিত বলভদ্র বসুর সাথে। বলভদ্র বসু দেখতে কালো ছিলেন বলে তার নামে ‘কালা রাজার বিল’ এবং কমলাদেবীর নামে ‘কমলা রানির দিঘি’ এখনও বিদ্যমান। রানি কমলা ও বলভদ্র বসুর পুত্র পরমানন্দ বসু থেকে চন্দ্রদ্বীপে ‘দেব’ বংশের স্থলে ‘বসু’ বংশের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। রাজা পরমানন্দ বসুর আমলে ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের সাথে চন্দ্রদ্বীপ রাজার একটি বাণিজ্যিক ও সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। পরমানন্দ বসুর পুত্র জগানন্দ বসুর মৃত্যুর পর কন্দর্পনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের রাজা হন। কন্দর্পনারায়ণ ছিলেন বাংলার ভুঁইয়াদের অন্যতম। মুগল আমলে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল এর রাজস্ব তালিকায় চন্দ্রদ্বীপ জমিদারি ‘বাকলা’ সরকারের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ৩টি পরগণায় বিভক্ত হয়।
আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখ আছে, রাজা কন্দর্পনারায়ণের আমলে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাকলায় এক মারাত্মক সাইক্লোন হয়। কন্দর্পনারায়ণ উপর্যুপরি মগ আক্রমণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ‘কচুয়া’ থেকে রাজধানী বরিশাল শহরের অনতিদূরে ‘মাধবপাশা’ নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন। মুগলরা ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্রের রাজত্বকালে রাজধানী মাধবপাশা আক্রমণ করে। রাজা রামচন্দ্র ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুগলবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মির্জা নাথানের মতে রামচন্দ্রকে তাঁর জমিদারির একটি অংশ জায়গির দেওয়া হয়। এ সময় থেকে মাধবপাশার রাজপরিবার একটি সাধারণ জমিদারে পরিণত হয়।
রামচন্দ্রের পর কীর্তিনারায়ণ, বাসুদেবনারায়ণ, প্রতাপনারায়ণ, প্রেমনারায়ণ জমিদার হন। প্রেমনারায়ণই মাধবপাশার বসুবংশীয় শেষ জমিদার। তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় জামাতা তাঁর গৌরীচরণ মিত্রের পুত্র উদয়নারায়ণ মিত্র জমিদার হন। উদয়নারায়ণ মিত্রের আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জেমস গ্রান্ট এর মতে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা নিয়াবতের অধীনে বাকলা সরকার ২২টি মহল এবং ১২টি পরগনায় বিভক্ত করা হয়। মাধবপাশার জমিদারদের অধীনে চন্দ্রদ্বীপ তখন একটি পরগণা মাত্র, যার রাজস্ব ছিল ৫৯,৭৩১ সিক্কা টাকা।
উদয়নারায়ণের পর শিবনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ ও জয়নারায়ণ মাধবপাশার জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজা জয়নারায়ণের আমলে প্রথমে দশশালা ও পরে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। এতে বাকলা সরকার ছোটবড় ৬০টি পরগনায় বিভক্ত হয়। এ সময় চন্দ্রদ্বীপ পরগনার রাজস্ব নির্ধারিত হয়েছিল ৮৩,০০০ সিক্কা টাকা। কিন্তু এ পরিমাণ রাজস্ব শোধ করার ক্ষমতা তখন রাজা জয়নারায়ণের ছিল না। ফলে খাজনা পরিশোধ করতে না পারার কারণে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মাধবপাশা জমিদারি নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। দাল সিংহ, জর্জ প্যানিয়াটি এবং মানিকমুদি নিলামে এ জমিদারির বিভিন্ন মহল ক্রয় করেন। বিশাল জমিদারির মাত্র কয়েকটি তালুক ও কিছু লাখেরাজ সম্পত্তি তখন অবশিষ্ট ছিল। মাধবপাশা জমিদার পরিবারের দুর্দশা দেখে বাংলার ছোটলাট স্যার চার্লস ইলিয়ট আলফ্রেড রাজা বীরসিংহ নারায়ণের পুত্র রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণকে পাতারহাটের সাব-রেজিস্টার নিযুক্ত করেন।
১৯৫০ সালের জমিদারি বিলুপ্তি আইনের আওতায় মাধবপাশা জমিদারির অবসান ঘটে এবং এর উত্তরাধিকারীগণ নিয়মমোতাবেক ক্ষতিপূরণ লাভ করেন।
মাধবপাশা জমিদারির নিদর্শন হিসেবে রামসাগর দিঘি এবং বরিশাল-মাধবপাশা রাস্তা এখনও টিকে আছে। মাধবপাশা জমিদার বাড়ি ও নিকটস্থ রামসাগর দিঘি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। রাজবাড়ি থেকে ‘রাজা কন্দর্পনারায়ণ’ নামাঙ্কিত একটি কামান আবিষ্কার হয়েছে। [দেলওয়ার হাসান]