ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তর
ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তর (Ground Water Hydrology Directorate) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ একটি দপ্তর। কৃষিকাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কৃষিপ্রকল্পের নকশা তৈরি ও নির্মাণ, নলকূপ উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা ও পৌর জলসরবরাহ ইতাদি উন্নয়নে ভূগর্ভস্থ পানি অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে-র একটি দল ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে ভূগর্ভস্থ পানি অনুসন্ধান প্রকল্পসমূহের উন্নয়নের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভূগর্ভস্থ পানি জরিপ’ নামে একটি স্কিম বাস্তবায়নকল্পে ১৯৭০ সালে গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল সৃষ্টি করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তর কাজ করে। এই দপ্তরটি সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে: (১) ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের একটি সাধারণ মূল্যায়ন (২) ভূ-জলস্তর, ভূ-ছিদ্র (rig) লগ, পানির গুণগত উপাত্ত ইত্যাদি ভূতাত্ত্বিক ও জল-ভূতাত্ত্বিক (hydrogeological) বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা (৩) সংগৃহীত উপাত্তসমুহ প্রক্রিয়াকরণ এবং কারিগরি প্রতিবেদন প্রকাশ (৪) জাতীয় পানি নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে উপাত্ত ও প্রতিবেদনসমূহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে সরবরাহ এবং (৫) পানিসম্পদ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনাবিদ ও নকশাবিদদের পরামর্শ সেবা প্রদান।
গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেলের প্রধান কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে: (১) ভূগর্ভস্থ পানির সাধারণ অবস্থা জরিপ ও দেশের উন্নয়নে এর সম্ভাবনা যাচাই (২) ভূ-জল অনুসন্ধান ও উপাত্ত সংগ্রহকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করা (৩) ভূগর্ভস্থ পানিবাহী স্তরসমূহের বৈশিষ্ট্য নির্ণয়কল্পে বিদ্যমান নলকূপ ও পরীক্ষা কূপসমূহে পাম্পিং টেস্ট সম্পাদন করা (৪) ভূগর্ভস্থ পানি অনুসন্ধানের ফলাফল ও মৌলিক উপাত্ত সকল প্রত্যাশী সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে সহজলভ্য করতে মৌলিক উপাত্ত উন্মুক্ত করা ও নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ করা এবং (৫) উপাত্ত সংগ্রহ ও মূল্যায়ন কার্যাদি যাতে দেশীয় জনশক্তিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেলক্ষ্যে একটি বিস্তৃত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা।
একজন পরিচালক ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিভাগীয় দপ্তরসমূহের প্রধান হচ্ছেন উপ-পরিচালকগণ। বর্তমানে দুটি বিভাগীয় দপ্তর কার্যরত রয়েছে: গ্রাউন্ড ওয়াটার ডিভিশন-১ ও গ্রাউন্ড ওয়াটার ডিভিশন-২। গ্রাউন্ড ওয়াটার ডিভিশন-১ এর আওতাভুক্ত অঞ্চলসমূহ হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট প্রশাসনিক বিভাগ এবং গ্রাউন্ড ওয়াটার ডিভিশন-২ এর আওতাভুক্ত অঞ্চলসমুহ হচ্ছে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ। ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তরের অন্য আরেকটি কার্যালয় সংগৃহীত উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ, বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন জল-ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র প্রণয়ন ও কারিগরি রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। বস্ত্তত এই কাজের দায়িত্বে ছিল অধুনালুপ্ত গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল-২। বিভাগীয় পর্যায়ে মাঠজরিপের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহের কাজটি ছয়জন উপ-বিভাগীয় ভূতত্তবিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ছয়টি গ্রাউন্ড ওয়াটার সাবডিভিশন অফিসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। উক্ত দপ্তরের অধীনে বর্তমানে সারাদেশে ১২৫০টি ভূগর্ভস্থ পানি স্তর পর্যবেক্ষন কূপ ও ১১৭টি ভূগর্ভস্থ পানির গুনগত মান পর্যবেক্ষন কূপ রয়েছে। ৬০ এর দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত পর্যবেক্ষন কূপসমূহ থেকে প্রতি সপ্তাহে পানির স্তর পরিমাপ করা হয়। গুণগত মান পর্যবেক্ষন কূপসমূহ থেকে বছরে ২ বার ভূগর্ভস্থ পানির ২০টি গুণাগুণ নির্ণয় করা হয়।
বর্তমানে উক্ত দপ্তর উপকূলীয় ১৯ টি জেলায় নতুন করে অগভীর ও গভীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও গুনগত মান পর্যবেক্ষন নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় নতুন পর্যবেক্ষন কূপসমূহ চালু হলে উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির উপাত্ত সংগ্রহ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।
ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ভূ-জল তথ্যভান্ডার হিসেবে কাজ করে এবং জাতীয় পানি নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহকে উপাত্ত সরবরাহ করে থাকে। অন্যদিকে গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ নির্ধারণ এবং ভূগর্ভস্থ পানিসেচের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর রীতিবদ্ধ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল বর্তমানে আর্সেনিকের উৎস অনুসন্ধান ও উপশম গবেষণায় সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রয়েছে।
ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তরের ২৪টি ছোট ও মাঝারি ধরনের রিগ ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, দুটি এয়ার কমপ্রেসর, দুটি জেনারেটর ও ১০টি পরিবহণ যান রয়েছে। দপ্তরটি থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ৫২টি জল-ভূতাত্ত্বিক বর্ষপঞ্জি, ৭৫টি জল-ভূতাত্ত্বিক রিপোর্ট, ২০টি জল-ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র এবং ১০টি টেকনিক্যাল ম্যানুয়েল ও নীতি নির্দেশনা প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা বাংলাদেশে বিভিন্ন ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ জল প্রকল্প বাস্তবায়নে জল-ভূতাত্ত্বিক উপাত্ত ব্যবহার করে থাকে। [আলমগীর হোসেন]