মুখগহবরের স্বাস্থ্য
মুখগহবরের স্বাস্থ্য মুখ, মুখগহবর, দাঁত ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গাদির সাধারণ স্বাস্থ্য অবস্থা। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশের অধিক লোকের কমপক্ষে এক বা একাধিক মুখ বা দাঁতের রোগ আছে। দন্তাবরক প্রদাহ, মাড়ি প্রদাহ, দন্তক্ষয়, দন্তশূল, দন্তমূলীয় ঘা ইত্যাদি প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া দাঁতের সিস্ট, মুখগহবরের ক্যানসার এগুলি বাংলাদেশে খুব সাধারণ সমস্যা। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা মুখের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত অজ্ঞ। সকাল বেলায় দাঁত মাযার জন্য তারা সাধারণত নিমের ডাল, ছাই ইত্যাদি ব্যবহার করে। গ্রামে দন্তরোগ চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা না থাকায় দাঁতের রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয়। বিদ্যমান চিকিৎসা সুবিধাগুলি বিবেচনা করলে গ্রামীণ জনগণকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং নকল দাঁত লাগানোর সুবিধা প্রদান কঠিন। তাই দাঁত পড়ে গেলে তারা সাধারণত নকল দাঁত ছাড়াই জীবন কাটায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পিতামাতাই সাধারণত দুধের দাঁত বা শিশুদের দাঁতগুলি সবই অস্থায়ী এবং স্থায়ী দাঁতে প্রতিস্থাপনযোগ্য ভেবে যত্ন বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। কোন দুধ-দাঁত রোগের কারণে পড়ে গেলে শিশুর খাদ্য চিবাতে অসুবিধা হয়। যেসব শিশু, বিশেষত যারা রাতের বেলায় বোতলে চিনি দেওয়া দুধ খেতে অভ্যস্ত সাধারণত তারাই অধিক সংখ্যায় দাঁতের ক্ষয়রোগে ভোগে, অর্থাৎ তাদের বেশির ভাগ দাঁতেই ক্ষয় দেখা দেয়। মানসম্পন্ন দন্তসেবার অভাবে গ্রামাঞ্চলে হাতুড়ে চিকিৎসার দুর্ভাগ্যজনক ব্যবসা চলছে। এসব হাতুড়েরা অশিক্ষিত, অপটু এবং এদের পেশাগত কোন জ্ঞান নেই। ঔষধ ব্যবহারের ব্যাপারে এবং ১৯৮০ সালে প্রচলিত চিকিৎসা ও দন্তচিকিৎসা বিধি সম্পর্কেও এরা অজ্ঞ। এই আইনের ৩০নং ধারায় বলা হয়েছে যে, কাউন্সিলের নিবন্ধন ব্যতীত চিকিৎসা বা দন্তচিকিৎসার পেশা চালানো অবৈধ, অর্থাৎ দেশী চিকিৎসা বা দন্তচিকিৎসা দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ। আইনের ১৫ (৩) নং ধারায় ১৯৮০ সালের আগে দন্তচিকিৎসায় অন্তত পাঁচ বছরে অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন শিক্ষাগত যোগ্যতাহীন দন্তচিকিৎসকদের একটি ট্রাইব্যুনাল দ্বারা নিবন্ধিতকরণের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে দন্তচিকিৎসকের সংখ্যা সর্বনিম্ন, প্রায় ২ লক্ষ লোকের জন্য একজন। এদেশে মুখগহবরের চিকিৎসা সাধারণত জেলা হাসপাতালের দন্তচিকিৎসকরাই দিয়ে থাকেন। এসব স্থানে দাঁত তোলা, দাঁত চাঁচা (scaling) ও গর্তভরাট ইত্যাদি ছোটখাটো শল্যচিকিৎসা ও দাঁতের সাধারণ চিকিৎসা করা হয়। ঢাকা ডেন্টাল কলেজের সঙ্গে একটি ডেন্টাল হাসপাতালও আছে, যেখানে রোগীদের বিনামূল্যে সব রকম চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া অনেক বেসরকারি ডেন্টাল ক্লিনিকও অর্থের বিনিময়ে দাঁতের চিকিৎসা করে। বিভিন্ন স্থানে কিছু স্বেচ্ছামূলক দন্তচিকিৎসা শিবির ছাড়া গ্রামাঞ্চলে দন্তচিকিৎসার আর কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। এসব অস্থায়ী শিবিরের কার্যক্রম সচরাচর দাঁত তোলা, দাঁতের ঘষা-মাজা ও অস্থায়ী মেরামতের মধ্যেই সীমিত থাকে।
বাংলাদেশে বহু মানুষ কুফলের কথা না জেনেই পান-সুপারি খায়। সুস্বাদু করার জন্য অনেক সময় পানে জর্দা, খয়ের, তামাকপাতা ইত্যাদি নানা উপকরণও মেশানো থাকে। এসব উপকরণের প্রতিটির নিজস্ব প্রতিক্রিয়া আছে এবং এগুলির মধ্যে প্রধানতম ভূমিকা সুপারির, যাতে অ্যারিকোলিন, ট্যানিন ও অন্যান্য উপক্ষার থাকে। অ্যারিকোলিনের ভূমিকা সিগারেটের নিকোটিনের সমতুল্য। এটি মুখের মিউকাস আবরণীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়ায়। সুপারিতে বিদ্যমান ট্যানিন মুখগহবরের কোষগুলিকে কিছুটা চুপসে দেয়। পানের সঙ্গে ব্যবহূত চুন পানের বিপাকক্রিয়ার সময় উপক্ষারগুলি বিযুক্ত করে। পান চিবানোর ফলে পাকস্থলীতে নিঃসৃত অম্লরস এসব বিযুক্ত উপক্ষারকে সক্রিয় করে তোলে। পানপাতায় থাকা ইথার জাতীয় তেল জিহবাকে কিছুটা অসাড় করে ফেলে। নিয়মিত ও অত্যধিক পান খাওয়ার ফলে মুখের স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি কমে যায়। পান খেলে দাঁতের ও মুখের স্বাস্থ্যের ওপর কিছু কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিয়মিত পানভোজীদের দাঁতের গোড়ায় পাথর জমে এবং তারা মাড়ির দুর্বলতায় ভোগে। মাড়িক্ষয় ছাড়াও দাঁতের যেসব হাড় দন্তমূলকে চোয়ালের উপর শক্তভাবে আটকে থাকতে সহায়তা করে সেগুলি কখনও কখনও ক্ষয়ে যায় এবং ফলে দাঁত নড়বড়ে হয়ে ওঠে ও অকালে পড়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত পান চিবানোর ফলে দাঁতের এনামেলের সঙ্গে ঘষা লেগে দাঁতে শিরশিরানিসহ নানা অসুবিধা দেখা দেয়। পান চিবানোর ফলে মুখের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধির প্রমাণও রয়েছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও সেগুলির চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানা কুসংস্কার আছে। অনেকে এখনও বিশ্বাস করে যে, ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁতের ভেতর পোকা জন্মে বলেই দাঁতব্যথা হয়। এই ভুল বিশ্বাসের ফলে অনেক লোক দাঁতের ব্যথার উপশমের জন্য বেদেনীর সাহায্য নেয়। তারা নানা রকমের ঝাড়-ফুঁকের দ্বারা পোকা দেখায় এবং রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। অথচ দাঁত ব্যথার প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে: দাঁতের অভ্যন্তরীণ শাঁসের প্রদাহ এবং মাড়ির অসুখ। দাঁত ক্ষয়ে গেলে তাতে ছোট ছোট গর্ত হয় এবং এই দন্তক্ষয়ের ফলে দাঁতের শাঁসে প্রদাহ দেখা দেয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। [মোঃ আশরাফ হোসেন]